৭৬ শিশু মারা গেল ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে
এ,কে,এম শফিকুল ইসলামঃ রিড ফার্মার ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে ২৮ শিশুর মৃত্যুর মামলায় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের সচিবের ব্যাখ্যা গ্রহণ করেননি হাইকোর্ট। এ বিষয়ে যথাযথ ব্যাখ্যা নিয়ে স্বাস্থ্য সচিবকে আগামীকাল বৃহস্পতিবার ফের হাজির হতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আজ বুধবার বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এ সময় ৭৬ শিশু মৃত্যুর অন্য দুটি মামলার প্রসঙ্গ টেনে স্বাস্থ্য সচিবের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘আগামীকাল যথাযথভাবে ব্যাখ্যা দেবেন। ৭৬ শিশু মারা গেল। আপনার (সচিব) ছেলেমেয়ে এখানে থাকে না। যারা মারা গেছে, এরা কি মরার জন্য জন্মেছে? এটা দুর্ভাগ্যজনক। এ দেশ গরিব হতে পারে। তবে এভাবে শিশুরা মারা যাবে, সে শিক্ষা তো কাউকে দেয়নি। গত বছর বিচারিক আদালতে ২৮ শিশু মৃত্যুর মামলায় সব আসামির খালাস রায় হয়। এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের দুই কর্মকর্তার পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। সচিবের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কামরুল হক সিদ্দিকী। গত ২১ আগস্ট স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে তলব করেন হাইকোর্ট। এর পরিপ্রেক্ষিতে আজ আদালতে হাজির হন সচিব। মনজিল মোরসেদ বলেন, রিড ফার্মার ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে ২৮ শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় আদালতের রায়ে ঔষধ প্রশাসনের দুই কর্মকর্তার অদক্ষতা ও অযোগ্যতা এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে অবহেলার বিষয়টি উঠে আসার পর তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জানতে চেয়েছিলেন হাইকোর্ট। এরপর স্বাস্থ্য সচিবের পক্ষে গত সোমবার একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, ওই দুই কর্মকর্তাকে সতর্ক করা হয়েছে। অথচ আদালত জানতে চেয়েছিল, কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? ব্যবস্থা না নেওয়ায় ব্যাখ্যা দিতে স্বাস্থ্য সচিবকে ২৩ আগস্ট তলব করেছেন হাইকোর্ট। ওই দুই কর্মকর্তা হলেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শফিকুল ইসলাম ও উপপরিচালক আলতাফ হোসেন। আদালত বলেন, ‘১৬ মার্চ থেকে বিবাদীরা বসে আছে। কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ওই ঘটনায় মোট ৭৬ শিশু মারা গেছে। আপনি (দুই কর্মকর্তা) বহাল তবিয়তে আছেন। আর বলছেন, দেখতেছি। এ সময় ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, ‘আগে সতর্ক, তারপর বরখাস্ত। সতর্ক না করলে জটিলতার সৃষ্টি করত। আদালত বলেন, ‘আপনারা (দুই কর্মকর্তা) তো জামাই আদরে আছেন। মনজিল মোরসেদ বলেন, দুজনকে বদলি বা সাসপেন্ড কিছু করেনি। তখন আদালত বলেন, ‘ব্যবস্থা তো নেওয়া হয়নি। আমরা তো আগে থেকেই বলে আসছি। পরে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার এ বিষয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেন। আদালত বলেন, ‘কোর্টকে আর খাটো করার চেষ্টা করবেন না। মার্চ থেকে বলে আসছি। এক পর্যায়ে কামরুল হক সিদ্দিকী বলেন, ‘ব্যবস্থা নেওয়ার আগে শোকজ, তদন্ত আছে। আমরা ব্যাখ্যা তৈরির জন্য সময় পাইনি। আমাদের সময় দরকার। ভেজাল প্যারাসিটামল খেয়ে ৭৬ শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় ১৯৯২ সালে দুটি মামলা করা হয়। ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট ঢাকা বিভাগীয় বিশেষ জজ ড্রাগ আদালত মামলাটির রায় ঘোষণা করেন। এতে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বিসিআই (বাংলাদেশ) পরিচালক, ব্যবস্থাপকসহ ছয়জনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আসামিরা হলেন বিসিআইর তৎকালীন পরিচালক মো. শাহজাহান সরকার, উৎপাদন ব্যবস্থাপক এনতাজুল হক, মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপক আয়েশা খাতুন, নির্বাহী পরিচালক এএসএম বদরুজ্জোদা চৌধুরী, পরিচালক সামসুল হক ও নূরুন্নাহার বেগম। মামলা সূত্রে জানা যায়, প্যারাসিটামল সিরাপে (ব্যাচ নম্বর ৯২১০০২) বিষাক্ত উপাদান থাকায় ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে অনেক শিশু কিডনি সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে কমপক্ষে ৭৬ জনের মৃত্যু হয়। বিষয়টি অনুসন্ধানের পর রাজধানীর জিগাতলার কারখানায় বিসিআইয়ের উৎপাদিত প্যারাসিমসহ পাঁচ কোম্পানির তৈরি প্যারাসিটামল সিরাপে বিষাক্ত পদার্থ ধরা পড়ে। এ ছাড়া ২৮ শিশুর মৃত্যুর মামলায় বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত রিড ফার্মার ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ পানে ঢাকা, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কমপক্ষে ২৮ শিশুর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক মো. শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে ঢাকার ড্রাগ আদালতে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় বলা হয়, রিড ফার্মাসিউটিক্যালস রিড সাসপেনশনের পরিবর্তে সিরাপ তৈরি করে, যা ভেজাল ও বিষাক্ত। মামলার বিচার শেষে গত বছরের ২৮ নভেম্বর পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দেন বিচারিক আদালত। ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছিলেন, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর মামলাটি করার ক্ষেত্রে ১৯৮০ সালের ড্রাগ আইন যথাযথভাবে অনুসরণ করেনি। মামলায় যথাযথভাবে আলামত জব্দ করা, তা রাসায়নিক পরীক্ষাগারে প্রেরণ এবং রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন আসামিদের দেয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রে ড্রাগ আইনের ২৩, ২৫ ধারা প্রতিপালন করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে তৎকালীন ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক শফিকুল ইসলাম ও আলতাফ হোসেন চরম অবহেলা, অযোগ্যতা ও অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।