Monday , 23 December 2024
সংবাদ শিরোনাম

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী ও শোক প্রকাশ-বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিঃ আবুল হোসেন (আবু)

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় এক ভাষণে কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্্ দম্ভ করে বলেছিলেন, টৎফঁ রিষষ নব ঃযব ংঃধঃব ষধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ. ঐ জনসভায় দাঁড়িয়ে মুসলিম লীগ থেকে বহিস্কৃত তৎকালীন গণতান্ত্রিক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জননেতা শামসুল হক বলেছিলেন, ঘড়. ঘড়. ইবহমধষর রিষষ নব ঃযব ংঃধঃব ষধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ নবপধঁংব বি ধৎব ৫৬% ধহফ ুড়ঁ ধৎব ৪৪%. ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারী পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল খাজা নাজিমউদ্দিন, মি. জিন্নাহ্র অনুসরণে ‘উর্দুই হবে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণা করলে পূর্ব-পাকিস্তানের তথা আজকের বাংলাদেশের সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় উঠে। তখন নুরুল আমীন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের (আজকের বাংলাদেশ) মূখ্যমন্ত্রী। পূর্ব বঙ্গের নুরুল আমীন সরকার ঢাকার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের মাধ্যমে ঐ সময়ের ছাত্রদের আন্দোলনের প্রস্তুতির তীব্রতা ও অনমনীয়ভাব দেখে ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মাসের জন্য কোতয়ালী, সূত্রাপুর, লালবাগ, রমনা ও তেজগাঁও থানার অন্তর্গত সমুদয় এলাকায় ১৪৪ ধারা জারী করে ঢাকা শহরে সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে দেন।২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কর্মপরিষদের যে বৈঠক হয় সেখানে ১১-৪ ভোটে ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত হয়, তবে ছাত্রনেতা অলি আহাদ এর বিরোধিতা করেন। এ প্রসঙ্গে গাজীউল হক বলেন, মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি গোলাম মওলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আব্দুল মতিন, এরা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে জোড়ালো বক্তব্য রাখেন। ফজলুল হক হলের সহ-সভাপতি শামসুল আলম এদেরকে সমর্থন করেন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কর্মপরিষদের ব্যানারে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনের সময় ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট, সভা ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কর্মপরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে অবস্থান করলে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ছাত্র নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা ও ফজলুল হক হলের মাঝখানের পুকুর পাড়ে বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকে ১১ জন ছাত্রনেতা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা হলেন- গাজীউল হক, হাবিবুর রহমান শেলী, মোহাম্মদ সুলতান, এম আর আখতার মুকুল, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মোমিন, এস.এ. বারী এ.টি; এম. সৈয়দ কামরুদ্দীন, আনোয়ারুল হক খান, মঞ্জুর হোসেন এবং আনোয়ার হোসেন। ঐ বৈঠকে ৯-২ ভোটে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পাশাপাশি সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা, গণতান্ত্রিক যুবলীগের নেতা ও কর্মীরা এবং ছাত্রনেতাদের কয়েকজন, পৃথকভাবে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে এসে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।বেলা ১১টা; ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনের প্রাঙ্গন (বর্তমান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ); ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজ থেকে ছাত্ররা এসে সভাস্থলে জমায়েত হতে শুরু করল। সেদিন গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে বক্তব্য রাখেন টাঙ্গাইলের কৃতি সন্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সেক্রেটারী তরুন জননেতা শামসুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আব্দুল মতিন এবং বাংলাদেশের প্রয়াত পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবদুস সামাদ আজাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মরহুম মোজাফফর আহমদ চৌধুরী এ ব্যাপারে সমর্থন প্রদান করে কলাভবনের লোহার গেট খুলে দেয়ার নির্দেশ দেন।বেলা ১টা। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলীর (পরবর্তীকালে প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা) নেতৃত্বে ১০ জন ছাত্রের ১ম দল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই শ্লোগান দিতে দিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় নামলে পুলিশ তাঁকেসহ কয়েক জনকে গ্রেফতার করতঃ ট্রাকে করে তেজগাঁও থানার দিকে চলে যায়। আবদুস সামাদ আজাদ (পরবর্তীকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ও ইব্রাহিম তোহার নেতৃত্বে ১০ জন ছাত্রের ২য় দল এবং আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ও আনোয়ারুল হক খানের নেতৃত্বে ১০ জন ছাত্রের ৩য় দল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় এলে এ দু’টো দলের প্রায় সকলকেই পুলিশ গ্রেফতার করে ট্রাকে উঠিয়ে অন্যান্য থানার দিকে নিয়ে যায়। মোহাম্মদ সুলতান, আজাহার ও হাসান হাবিবুর রহমান ছাত্র-ছাত্রীদেরকে সংগঠিত করে রাস্তায় নামাচ্ছিলেন। এবার ডা. সাফিয়ার নেতৃত্বে কিছু সংখ্যক ছাত্রীর ৪র্থ দল রাস্তায় বের হলে ডা. সাফিয়া, রওশন আরা বাচ্চু, সুফিয়া ইব্রাহিম, শামসুন নাহারসহ অনেকেই গ্রেফতার হন। পুলিশ উপুর্যপুরি কাঁদানে গ্যাস ছাড়তে থাকে। চতুর্দিকে শুধু ধোয়া ধোয়া। এমন সময় কাঁদানে গ্যাসের একটি সেল সরাসরি মোহাম্মদ সুলতানের বুঁকে আঘাত হানলে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের মাঝখানের দেয়াল টপকিয়ে মেডিক্যাল হোস্টেলের প্রধান ফটকের কাছে জমায়েত হন। ঐ দিন ছাত্র-ছাত্রীরা বেলা প্রায় ২টা পর্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে গ্রেফতার বরণ করতে থাকেন।তখন ধীরে ধীরে ছাত্ররা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে, মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গেটে জমা হতে থাকে। দলবদ্ধ হয়ে শ্লোগান দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করে পথে বেরিয়ে এলে এবং প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের দিকে যাবার চেষ্টা করলে পুলিশ যখন তাঁদের ওপর প্রচন্ড কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ, বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও পাইকারী গ্রেফতার শুরু করে, তখন মেডিক্যাল কলেজের ওয়ার্ড বয়, বেয়ারা, মেডিক্যাল হোষ্টেল সংলগ্ন রাস্তার পাশে রেস্টুরেন্টের বয় বেয়ারা, পথচারী, রিকশাওয়ালা প্রমূখ তাদের সঙ্গে যোগদান করে। এ সময় এমএলএ ও মন্ত্রীরা মেডিক্যাল কলেজের সামনে দিয়ে পরিষদে আসতে থাকেন। ছাত্ররা যতই শ্লোগান দেয় আর মিছিলে একত্রিত হয় পুলিশ ততই হানা দেয়। কয়েকবার ছাত্রদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে তাড়া করতে করতে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের ভেতর ঢুকে পড়ে। হোস্টেল প্রাঙ্গণে ঢুকে ছাত্রদের উপর আক্রমণ করায় ছাত্ররা বাধ্য হয় ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকেন। পুলিশ তখন দিগি¦দিক শূন্য হয়ে তিনটা দশ মিনিটের সময় কোন রকম পূর্ব সংকেত ছাড়াই তৎকালীন মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের উল্টো দিক থেকে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট কোরেশীর নির্দেশে যমদূতের মত দৌঁড়ে হোস্টেলের প্রবেশ দ্বারে পজিশন নিয়েই ছাত্রদের উপর গুলি চালায়। চারিদিকে কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ার মধ্যে কেউ কিছু বুঝবার আগেই ঢাকার বুঁকে সংঘটিত হলো একটি নারকীয় হত্যাকান্ড। কয়েকটি অমূল্য জীবন মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। হারিয়ে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বরকত (আবাই), আঃ জব্বার, রফিকউদ্দীন, সফিউর রহমান (সফিক), সালাউদ্দিন এবং ঢাকার বাদামতলীর প্রেস কর্মচারী আব্দুস সালাম ও একজন অজ্ঞাত রিকশাচালক। তাঁদের বুঁকের তাঁজা রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন মহান মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে।প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণঃ
আবুল বরকতের গুলি খাওয়া সম্পর্কে এস.এ. বারী এ.টি. বলেছেন, বরকত, ডাকনাম, আবাই পুলিশের গুলি খেয়ে আমার পাশে এসে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। তখন তার দুই ঠ্যাং সফিকুর রহমান কাঁধে তুলে নিলেন আর মাথা নিলাম আমার কাঁধে। আমার কাছে পানি চাইল কিন্তু কোথায় পানি, সময় নাই, পুলিশ দেখলে কেড়ে নিতে পারে, তাই পড়িমরি করে ছুটছি। ভেজা রুমালটা দিলাম চুষতে। ‘সে বল্ল, খুব কষ্ট হচ্ছে, বাঁচব না, বিষ্ণুপ্রিয়া ভবন, পুরানা পল্টনে সংবাদ পৌঁছে দেন। তাঁকে নিয়ে জরুরী ওয়ার্ডে নামলাম, আমি দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই স্ট্রেচারে করে একজনকে মৃতদেহ আনতে দেখলাম। মাথার খুলি উড়ে গেছে। নীচের দিকে খানিকটা ঘিলু ঝুলছে। শুধু দাঁতগুলো দিয়ে হাসছে যেন আমাদের দিকে তাঁকিয়ে।এম আর আখতার মুকুল সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘বেলা তিনটা দশ মিনিটের সময় আকস্মিকভাবে একদল সশস্ত্র পুলিশ মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের মধ্যে প্রবেশ করে এবং গুলিবর্ষণ করে। ঘটনাস্থলে জব্বার ও রফিকউদ্দীন নিহত হন।ঐ দিনের ঘটনার বিষয়ে মোহাম্মদ সুলতান বলেছেন, ‘কত রাউন্ড গুলি চলেছিল জানা যায়নি। শহীদ হলেন একজন রিকশাচালক এবং বরকত, জব্বার, সালাউদ্দিন প্রমূখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে বা রাস্তায় যাঁরা শহীদ হলেন, পুলিশ বাহিনী সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের নিয়ে গাড়িতে তুললেন। ১৪৪ ধারা আর রলো না। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাস মহান তীর্থস্থানে পরিণত হলো। এ ঘটনায় ঢাকার সমস্ত অফিস-আদালত, কল-কারখানা, রেডিও, রেলগাড়ির চাকা ও রিকশা চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। হাজার হাজার লোক মেডিক্যাল কলেজে এসে জমা হতে থাকলেন। কান্নার রোল পড়ে গেল চতুর্দিকে। পুলিশ বাহিনী সরে পড়েছে। ঢাকার রাস্তায় কোথাও একটি পুলিশ নেই।সত্যিই ছাত্র-জনতার রক্তের ¯্রােত এক ফুঁয়ে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল পূর্ব-বঙ্গ সরকারের সমস্ত ব্যারিকেড। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রত্যাশার মুখে ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিকদের হিসাব-নিকাশের রাজনীতিও উড়ে যায়। একুশে ফেব্রুয়ারি ঠিক কতজন মারা যান, তা জানার আজ আর উপায় নেই। পুলিশ অনেক লাশ সরিয়েছে।একুশে ফেব্রুয়ারির ছাত্র সভায় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনের যে প্রতিফলন ঘটেছিল, তা শুধু ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসেই নয় বাঙালি জাতির পরবর্তীকাল ও বর্তমানেও বাংলাদেশের যেকোন আন্দোলন সংগ্রামের জন্য প্রেরণাদায়ী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক ন্যায় বিচার, রাজনৈতিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনের ত্যাগ তিতিক্ষাকে অনুসরণ করে বেঙ্গল জাতীয় কংগ্রেস (বিজেসি)-র ৮ দফা কর্মসূচিকে বাস্তবায়নের জন্য নতুন প্রজন্ম এগিয়ে যাবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, আমরা পরম করুণাময় আল্লাহ্্ তায়ালার নিকট তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি, যাতে তাঁরা বেহেশতের জান্নাতুল ফেরদাউসে বসবাস করার সুযোগ পান।মহান আল্লাহ্্ পাক আমাদের সহায় হোন।

 

 

 

 

 

 

 

 

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top