Monday , 23 December 2024
সংবাদ শিরোনাম

রহস্যময় পাথর গল্প

কদিন ধরে সংবাদপত্রের পাতায় কী সব অদ্ভুত অদ্ভুত খবর বের হচ্ছে। এইতো মাসখানেক আগেই পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্য নিয়ে কি এক গ-গোল শুরু হয়েছিল। বিজ্ঞানীদের এই উল্লাস আবার চুপসে যাওয়া মুখের ছবি ক্রমাগত পত্রিকার দুই তিন পাতা দখল করে নিয়েছিল। এখন অবশ্য কিছুটা কমেছে কিন্তু সেই গবেষণার রেশ কিন্তু চলছে এখনও। ”কিন্তু আজ পত্রিকায় নতুন আরেকটা খবর। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম আমাদের এই গ্রামকে নিয়ে লেখা হয়েছে। হকচকিয়ে উঠে পুরু কলামটা পড়া শুরু করলাম। আজ থেকে প্রায় পাচশ’ বছর আগে এইখানে নাকি বিশাল বড় এক দুর্গ ছিল। কিন্তু তখনতো এসব জায়গায় জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কালক্রমে সেইসব জঙ্গল, দুর্গ মুছে গিয়ে এখন শুধু ইতিহাসের সাক্ষী। কিন্তু কিছুটা হলেও এর অস্তিত্ব তো আছেই। এই যেমন বড় বড় পাথরের স্তূপ। তবে এখানে বড় কোন পাথরের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। তাই নিয়ে ইতিহাসবিদেরা কথা তুলেছে এতদিনে। পত্রিকার খবরটা পড়ে কেমন যেন স্বস্তির চেয়ে অস্বস্থিই কাজ করতে লাগল বেশি। রাতের ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে বাজছে। চোখে কোনো ঘুম নেই। একজন গবেষণাপ্রিয় আর বইপাগল মানুষ আমি। জ্ঞাণ অন্বেষণের জন্য সব ধরনের ভয় ভীতিকে তোয়াক্কা করতে রাজি আছি। পশ্চিম পাশের বন্ধ জানালাটা আস্তে করে খুলে দিতেই কোথা থেকে যেন ঠা-া এক শীতল হাওয়া প্রাণটাকে একেবারে জুড়িয়ে দিয়ে গেল। দূরের কোথাও শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক কানে ভেসে আসছে প্রতিনিয়ত। জোনাকির মিটিমিটি আলোর দৃশ্য দেখতে গিয়ে হঠাৎ সামান্য দূরের একটা আজব দৃশ্য চোখে পড়ল। আমবাগানের ঠিক উল্টোপাশটা থেকে কেমন যেন এক ধরনের ঝাপসা আলো ভেসে আসছে চোখে। দরজা খুলে অমনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। বুকের ভেতর সামান্য ভয় কাজ করছে। তবুও পিছপা হতে রাজি নই। নারিকেল গাছের পাশ কেটে যাওয়ার সময় ওপর থেকে কি যেন একটা ধপাৎ করে পড়ল একেবারে সামনে। বুকটা ধুক করে উঠল। টর্চ লাইটটা সেইদিকে তাক করে দেখি একটা ঝুনো নারিকেল। কপালের ঘামটা আস্তে করে হাত দিয়ে মুছে আবারও সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। আলোটার প্রায় কাছাকাছি। আমবাগানের বিপরীত পাশে পুরনো একটা পরিত্যক্ত পুকুর। তাতে আমার বাপ-দাদার আমল থেকেই কোনো প্রকার পানি নেই। কেন বা কি কারণে পুকুরটা খনন করা হয়েছিল তা কেউ জানে না। পরবর্তী প্রজন্মের মাথায়ও নতুন কিছু চিন্তা বা পরিকল্পনা আসেনি পুকুরটা নিয়ে নতুন কিছু একটা করার। মাছের চাষও তো করা যায়। এ নিয়ে বাবার সঙ্গে কম কথা কাটাকাটি করিনি। কিন্তু লাভ হয়নি। নোংরা পুকুরটা দিনে দিনে ভরাট হয়ে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু সেই নোংরা পুকুরটা থেকেই যে ঝাপসা ঘোলাটে ঘোলাটে আলো বের হচ্ছে সেই ব্যাপারে হানড্রেড পারসেন্ট কনফার্ম। চোখ দুটা আরও বিস্ময়কর হয়ে উঠল যখন পুকুরটার মাঝখানে নেমে পড়লাম। এ যেন রহস্যময় কোন এক মায়াজালের ফাঁদ। ক্রমাগত আমাকে সেইদিকে যাওয়ার জন্য টানছে। আর আমি সেই টানে পাগলের মতো কাছে ছুটে যাচ্ছি। পায়ের নিচে মাটি আছে কিনা জানি না। থরথর করে কাঁপছে আমার শরীর। কিছু ঝনঝনানি শব্দ নতুন করে শুরু হলো। পায়ের নিচে বোধ হয় শুকনো মচমচে পাতার স্তূপ। লাইটটা সেইদিকে তাক করার কোনো ইচ্ছে প্রকাশ করলাম না। আলোটার উৎপত্তি বোধ হয় এখানেই। বা হাতটা দিয়ে আস্তে করে উপরের কিছু গাছের পাতা সরাতেই ঠা-া কিছু অনুভব করতে পারলাম। আর আমার সারা গা শিরশির করে কাটা দিয়ে উঠল। এবার লাইটের আলোটা ভালোভাবে জ্বালিয়ে দেখি মস্ত একটা পাথর। এবং আলোটা সেই পাথর থেকেই আড়ছে। কিছু নিশ্চিৎ হলেও মনের ভেতর খটকা লেগেই থাকল। এই পাথরের নিচে কি আছে সেটা দেখতে পারলেই রহস্যের কিছুটা উন্মোচন হবে নচেৎ নয়।পরের দিন। স্কুল থেকে ফিরে এসেই দাদুর কাছে ছুটে গেলাম। জানতে চাওয়ার প্রবল ইচ্ছাগুলো দাদুর কাছে পেশ করতেই দাদু হকচকিয়ে উঠল। চোখ দুটো বড় বড় করে বলল, ‘ওপরওয়ালার কাছে হাজার শুকর যে তুই বেঁচে ফিরেছিস্। আর ভুল করেও ঐ পরিত্যক্ত পুকুরটার কাছে যাস্ না। ওটাকে মৃত্যুপুকুরও বলা যেতে পারে।”মানে? কিন্তু আমিতো সেই জায়গাটাকে গত মধ্যরাতে পরখ করে দেখেছি। কই, কিছুই তো হলো না আমার। শুধু বিশালাকার একটা পাথর দেখতে পেলাম। আর তার নিচ থেকে কেমন যেন ঝাপসা এক ধরনের আলো বের হচ্ছিল। চেষ্টা করলাম পাথরটাকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরাতে কিন্তু পারলাম না তো!’
‘তুই ওটা পারবি না। শুধু তুই কেন, কারও একার পক্ষে ঐ পাথরটা সরানো সম্ভব নয়। তাহলে একটা গল্প শোন। আমি যখন তোর মতো কিশোর বয়সে ছিলাম তখন আমিও রাত-বিরাতে নদীর পাড়, জঙ্গল বা বাগানের পাশে বসে বসে রাতের আকাশ দেখতাম। তখন তো দুনিয়াটা অন্ধকারাচ্ছন্নই ছিল। আমি ছিলাম সবার থেকে একটু আলাদা। একটু স্বপ্নপাগল, ইচ্ছেপাগল। আজকের এই জায়গাটা তখন গাছ গাছালি দিয়ে পূর্ণ ছিল। এক কথায় আশপাশের এইসব জায়গাগুলো পুরুটাই একদম জঙ্গল ছিল। আমি একবার সন্ধ্যার পর আর বাড়ি ফিরিনি। আমার বন্ধুর সঙ্গে খালের পাড়ে বসে বসে গল্প করছিলাম। রাত কোনদিক দিয়ে বাড়ছিল কিছুই টের পাইনি। আনুমানিক বলতে পারি মধ্যরাত হতে বোধ বেশিক্ষণ আর বাদ ছিল না। এমন সময় এক দল লোককে দেখতে পাই। হারিকেন জ্বালিয়ে জঙ্গলের পাশ দিয়ে চুপচাপ এগিয়ে আড়ছে এদিকেই। আমরা দুই বন্ধু মিলে লুকিয়ে পড়ি নারিকেলের ঝোঁপে। সেই এক দল লোক আস্তে আস্তে পরিত্যক্ত পুকুরটার ভিতরে নেমে ঠিক তোর মতোই ময়লা আবর্জনাগুলো সরিয়েছিল। তারপর বিশাল পাথরটা কোনোমতেই সরাতে পারছিল না। ওরা কীভাবে এই রহস্যময় জায়গাটার কথা জেনেছিল কিছু বলতে পারব না। ওখানে দু-তিনটা সুপারি গাছ ঘেরাও ছিল বলে ধারালো ধারালো খন্তি দিয়ে এক কোপে কেটে ফেলেছিল গাছগুলো। তবুও পাথরটা সরাতে পারছিল না কোনোভাবেই। অবশেষে আরও কয়েকটা লোক এসে জমা হলো কোথা থেকে যেন। তারপর সবাই মিলে যেই পাথরটা হালকা উঁচু করেছে অমনি নিচ থেকে দুটি বড় বড় গোখরো সাপ ফনা তুলে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দু’জন ছাড়া আর কেউই বাঁচতে পারেনি সেদিন। স্বচক্ষে আমি আর আমার বন্ধু দেখেছি এই দৃশ্যটা। তবে যারা বেঁচে গেছে তাদের মুখ থেকে শুনা যায় ওই পাথরটার নিচে নাকি গর্ত রয়েছে। আর তাতে মনি মুক্তার অভাব নেই। কিন্তু পরবর্তীতে আর কেউই সাহস করে সেই ধনরত্ন পাওয়ার আশায় জীবন বাজি রাখতে যায়নি।’দাদুর মুখে গল্প শুনে বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে, এটা একটা বাস্তব ঘটনা। তবে আমার ভাগ্যটা বোধ হয় ভালোই ছিল যে পাথরটা উঁচু করার চেষ্টা চালিয়েও পারিনি। এ খবরটা ঝড়ের গতিতে আমার বিশ্বস্ত বন্ধু রাফিদকে জানিয়ে দিলাম। ঠিক করলাম দুইজন মিলে কিছু একটা করার। যে করেই হোক ওই পাথরটার আসল রহস্য দু’জনেই উন্মোচন করব। এত সহজেই প্রত্মতাত্তি্বকদের খবর দিচ্ছিনা। এক ধরনের লোভ কাজ করছিল। সন্ধ্যার আগেই আগন্তুক বন্ধু আমার বাড়ি এসে হাজির। বিভিন্ন ধরনের প্ল্যান-টস্নান মগজ ধোলাই করে নিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিলাম। ঠিক মধ্যরাতেই আমাদের আসল কাজ শুরু হবে।ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করছে। লাল টকটকে চোখ দুটোতে কোনো ঘুম নেই। বুকের ধুকধুকানি ঘুমোতে দিচ্ছে না। হঠাৎ বিছানার পাশ ফিরে দেখি রাফিদ নেই। টেবিলের ওপর রাখা টর্চ লাইটটাও নেই। সবকিছু কেমন যেন গ-গোল পাকিয়ে ফেলছি। তাহলে কি রাফিদ আমাকে একা রেখেই পরিত্যক্ত ওই পুকুরটার দিকে ছুটেছে। এত লোভ ওর! নির্ঘাত কিছু একটা ঘটতে চলেছে আজ। কেন যে ওকে এতকিছু বলতে গেলাম! শহরে গিয়ে একবার সাংবাদিকদের খবর দিলেই তো সবকিছুর সমাধান হয়ে যেত। যাক এখন আর ওইসব ভেবে কোনো লাভ নেই। যা হবার তা তো হয়েই গেছে। কোনোমতে রাফিদকে সেই রহস্যময় পাথরটার কাছ থেকে ফিরাতে পারলেই বাঁচি। হাতের কাছে হারিকেনটা পেয়ে ভালোই হলো। চুপিচুপি রান্নাঘর থেকে হারিকেনে আগুন ধরিয়ে ছুটে গেলাম কাঙ্ক্ষিত সেই জায়গায়। গত রাতের মতোই সবকিছু বিভীষিকাময় ও ভয়ঙ্কর। ঝিঁঝিঁ পোকার ক্লান্তিকর ডাকে কপাল দিয়ে ঘাম ঝরা শুরু করল। আস্তে আস্তে আরও সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। এবার আরও ভয়ঙ্কর কিছু অপেক্ষা করছে। নারিকেল গাছগুলোর পাশ কেটে আমবাগানের বিপরীত পাশে পেঁৗছাতে না পেঁৗছাতেই পাথরটার কাছে কি যেন একটা দেখতে পেলাম। হারিকেনের আলোটা আরও একটু ঘন করে দিতেই সবকিছু আরও স্পষ্ট হয়ে গেল। পাথরটার কাছে প্রায় তিনটা গোখরা সাপ ফনা ধরে ত্রিভুজাকৃতির মতো হয়ে ফসফস করছে। ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই মাটিতে কাকে যেন দেখতে পেলাম। মনে হচ্ছে একটা মানুষের লাশ। নিঃশব্দে হালকা একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি আমার বন্ধু রাফিদ। বিষধর সেই সাপগুলো তার সারাশরীরে বিষ ঢুকিয়ে থেতলে ফেলেছে। তারপর আর কিছু দেখতে পারি না। হাতের হারিকেনটা হাত থেকে ধপাস করে পড়ে চিমনি টা টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আর আমি অচেতন অবস্থায় সারা রাত পড়ে থাকি ওখানেই।সকাল হলে চোখ খুলে দেখি বিছানায় শুয়ে আছি। আর মাথায় কে যেন পানি ঢালছে। ভীষণ রকমের জ্বরে সারা শরীর কাঁপছে আর কাঁপছে। কান্নাকাটির আওয়াজও বেশ পাওয়া যায়। বাড়িভর্তি পুলিশ এসে হাজির। তারা নানান ধরনের তদন্ত নিয়ে ব্যস্ত। সারা গাঁয়ের মানুষ এসে জড়ো হয়েছে আমাদের বাড়ির উঠোনে। ততক্ষণে সেসব ইতিহাসবিদরাও এসে হাজির হয়ে গেছে। তাদের চোখে মুখে স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। তারা তাদের ধারণাকে সাকসেস করতে পেরেছে। দেশজুড়ে এই গ্রামের খবর বাতাসের বেগে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।কিছুদিনের মধ্যেই আমার অসুস্থ শরীর সুস্থ হতে থাকে। ভালো একটা দিন দেখে দাদু আমায় দূরের এক জেলা সিরাজগঞ্জে পাঠিয়ে দেয়। তারপর সেখানে থেকেই আমার পড়ালেখার নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়। আর কখনও অতীতের দিকে ফিরে তাকাইনি।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top