শ্বশুরবাড়ি মধুর হাঁড়ি। বাঙালি সংস্কৃতিতে ‘জামাই আদর’ বলে একটা কথা আছে। সাধারণত স্বজনদের মধ্যে ‘জামাই’ সবচেয়ে বেশি আদর-সমাদর পেয়ে থাকেন। শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গেলে নানা রকম খাবারদাবারের আয়োজন করেন শ্বশুর-শাশুড়ি। আত্মীয়ের চাপেই হোক আর পারিপার্শ্বিকতা ভেবেই হোক, জামাইকেও খেতে হয় নানা রকম খাবার। নতুন জামাই হলে তো কথাই নেই! পাতে একের পর এক আসতে থাকে রাজভোগ বা মুরগা-মুসাল্লামের মতো নানা পদের উপাদেয় খাবার। আদুরে শ্যালিকা-শ্যালকের আবদারে হয়তো একটু বেশিই খেতে হয়।কিন্তু হুট করেই এভাবে বেশি খাবার খেতে গিয়ে শরীরের ক্যালরির বাড়তি চাপ পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এতে হঠাৎ করে অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শ্বশুরবাড়ি বা আত্মীয়বাড়িতে বেড়াতে গেলে খাবারদাবারের কিছু পরামর্শ মেনে চলার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।বিশেষজ্ঞরা বলেন, আত্মীয়বাড়িতে বেড়াতে গেলে অনেকেরই জিব সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু এ সময় শরীর আর্দ্র রাখলে ক্ষুধা নিবারণ করা যায়।বারডেম জেনারেল হাসপাতালের প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান (খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগ) শামসুন্নাহার নাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা দীর্ঘ ভ্রমণ করে শ্বশুরবাড়ি বা কোনো আত্মীয়বাড়ি কিংবা বেড়াতে যান, যাত্রাপথে তাঁরা একটু উচ্চ ক্যালরিযুক্ত শুকনো খাবার খাবেন। তবে কড়া ভাজা বা চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে যাবেন। অনেকে পানি পান করেন না, যা ঠিক নয়। প্রচুর তরলজাতীয় খাবার খাবেন। এতে শরীরের ভারসাম্য ঠিক থাকবে। খারাপ লাগবে না।কোনো দাওয়াতে গেলে সব ধরনের খাবার খেতে পারেন, তবে তা খেতে হবে নিজের শরীরের অবস্থা বুঝে। যেমন ডায়াবেটিসের রোগীরা মিষ্টি খাবেন না। যতটুকু প্রয়োজন, ঠিক ততটুকু খাবেন। চাহিদার অতিরিক্ত খাওয়া ঠিক নয়। দৈনন্দিন যে পরিমাণ খাবার খান, দাওয়াতে গিয়ে হুট করে তার বেশি খাওয়া ঠিক হবে না। খাবার নির্বাচন করে খেতে হবে। খাসির মাংস, গলদা চিংড়ি কিংবা অতিরিক্ত তেল-মসলাযুক্ত খাবার যাঁদের সয় না, এ ধরনের খাবার তাঁদের এড়িয়ে চলাই ভালো। দাওয়াতে গেলে নানা ধরনের খাবার সামনে পেয়ে সব খেতে হবে—এ মানসিকতা আগে ছাড়তে হবে।শামসুন্নাহার নাহিদ বলেন, শ্বশুরবাড়ি কিংবা আত্মীয়বাড়িতে গেলে ‘অনুরোধে ঢেঁকি গেলা’ যাবে না। যাঁরা দাওয়াত দেন, তাঁদেরও মনে রাখতে হবে, অতিথিকে জোর করা ঠিক নয়। তাঁর শরীরের উপযোগী খাবার পরিবেশন করতে হবে। তাঁর জন্য প্রয়োজনে উপযোগী খাবার তৈরি করা যেতে পারে। সবার জন্য যে খাবার, তাঁর জন্যও একই খাবার রাখা ঠিক নয়। আতিথেয়তা ভালো, কিন্তু অতিথির উপযোগী খাবার গুরুত্বপূর্ণ বেশি। অতিথিকেও মনে রাখতে হবে, যা পেলাম, তা-ই খেলাম, এটা ঠিক নয়। পরিমাণ অনুযায়ী, শরীরের দিকে খেয়াল রেখে খেতে হবে।শ্বশুরবাড়ি গিয়ে অনেকে নিয়ম মানতে না পেরে বেশি খেয়ে অস্বস্তিতে ভোগেন। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে যেদিন বেশি খাবার খাবেন, সেদিন বাড়তি ক্যালরি ঝরাতে ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি অবশ্যই করবেন। এরপরও যদি পেটে অস্বস্তি লাগে বা অম্লতা হয়, অ্যান্টাসিড নিতে পারেন। তবে যে খাবার ভালো হজম হয়, সেটা খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। খাওয়ার পর ধনিয়া, ঘরে তৈরি লেবুপানি, ডেটক্স ওয়াটার, ফলের সালাদ, জুস খেতে পারেন। টকদই, টকদইয়ের লাচ্ছিও হজমের উপযোগী খাবার।
শ্বশুরবাড়ি গিয়ে খাবারদাবার সম্পর্কে ৮ পরামর্শ:
মিষ্টি সাবধানে খাবেন: মিষ্টি লোভনীয় নিঃসন্দেহে। শ্বশুরবাড়িতে জামাইয়ের জন্য নানা রকম মিষ্টি রাখা হয়। থাকে পিঠারও নানা আয়োজন। এ লোভ ঠেকানো হয়তো কঠিন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যত চিনি খাবেন, শরীর তত বেশি চিনি গ্রহণের জন্য উৎসুক হয়ে উঠবে। চিনিযুক্ত খাবারের বদলে স্বাস্থ্যকর কোনো খাবার খেতে পারেন।
ফল খান: মিষ্টি বা চিনিজাতীয় খাবারের বদলে ফল খান। শুকনো ফল, ফলের জুস, সালাদ মুখোরোচক হিসেবে খেতে পারেন। হালকা নাশতা হিসেবে শুকনো ফল খেতে পারেন। এতে হয়তো ক্যালরি বেশি, কিন্তু চকলেটের বিকল্প হতে পারে ফল।
নিয়মিত খান: সময়ের খাবার সময়ে খাবেন। একেবারে বেশি খাওয়া ঠিক নয়। আবার অনেক সময় না খেয়ে থাকাও ঠিক নয়। দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকলে রক্তে চিনির মাত্রা কমে যাবে। এতে চিনিযুক্ত খাবারের দিকে মন টানবে বেশি। আনন্দমুখর পরিবেশে অনেকে সময়মতো খান না। কিন্তু মাঝেমধ্যে স্বাস্থ্যকর হালকা নাশতা দিয়ে পেট ভরা রাখুন। এতে একবারে বেশি খাওয়া হবে না।
বেশি করে তরল খাবার খান: বেশি করে তরলজাতীয় খাবার খেলে ক্ষুধা কম লাগবে। তরল না খেলে বারবার খেতে ইচ্ছা করবে।
খাবার নির্বাচন করুন: কী খাবেন আর কী খাবেন না, সে বিষয়টি ঠিক করুন। সাধারণত বেড়াতে গেলে খাবার ও মিষ্টি খাওয়ার হিসাবে গরমিল হয়ে যায়। তবে ক্যালরি হিসাব করে খেতে পারেন। কোমল পানীয় কিংবা মিষ্টিজাতীয় বেভারেজ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকুন। এর পরিবর্তে পানি খান বেশি করে। চা খেলেও মিষ্টি চা না খাওয়াই ভালো। লেবুপানি কিংবা শসার জুস খেতে পারেন।
কম খান: কোথাও বেড়াতে গেলে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা। খাবারের ধরন যদি বেশি হয়, তবে অল্প অল্প করে তা খেয়ে দেখতে পারেন। খাবার এভাবে ভাগ করে খেলে কম খাওয়া হবে এবং শরীর ঠিক থাকবে।
ব্যায়াম করুন: শ্বশুরবাড়ি গেলেও শরীর একেবারে ছেড়ে দিয়ে খাওয়াদাওয়া করবেন না। নিয়মিত ব্যায়াম চালু রাখুন। হাঁটুন বা কিছুটা দৌড়ান। সকালে-বিকেলে শরীরচর্চা করুন।
গল্প করুন: মোবাইল ফোন, ফেসবুক ছেড়ে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে গল্প করুন। এতে খাবারের দিক থেকে মনোযোগ দূরে থাকবে।