অগ্রণী ব্যাংকে ভয়াবহ ঋণ জালিয়াতি ও প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। ঋণের আবেদনে প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক ঠিকানা, কিসের ব্যবসা এবং তা কতদিন ধরে করছেন- এসবের কোনো তথ্যই নেই। বলা চলে গায়েবি আবেদন। শুধু নাম আর কত টাকা ঋণ দরকার, তা উল্লেখ করে ১৮০ কোটি টাকার ঋণের আবেদন করে মেসার্স রূপগঞ্জ ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি অখ্যাত প্রতিষ্ঠান। আর এতেই মাত্র ৫ দিনের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটিকে এ পরিমাণ ঋণ অনুমোদন করে সরকারি খাতের অগ্রণী ব্যাংক। অথচ অসম্পূর্ণ আবেদনটির কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই করা হয়নি।বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশদ পরিদর্শনে ঋণ বিতরণের নামে এমন চাঞ্চল্যকর জালিয়াতি ও প্রতারণার তথ্য উঠে এসেছে। এ বিষয়ে যমুনা টিভি বুধবার একটি প্রতিবেদন সম্প্রচার করলে ব্যাংকপাড়ায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।সূত্র বলছে, ব্যাংকের তৎকালীন এমডি সৈয়দ আবদুল হামিদ ছাড়াও এ ঋণ অনুমোদনের পেছনে সরকারের প্রভাবশালী একটি চক্র জড়িত। যে কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পুরো বিষয়টি জানার পরও গত ৬ বছরেও শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবেদন দেয়ার পর এমডিকে অপসারণ করা হয়। এরপর দুদক মামলা করে।এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, এগুলোকে ঋণ বলার সুযোগ নেই। জালিয়াতি করলেও কিছু প্রমাণ থাকে। সে কারণে সরাসরি প্রতারণা বলা যায়। তিনি বলেন, এসব ঋণ নিয়ে প্রতারণা করেছেন অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডি সৈয়দ আবদুল হামিদ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তৎকালীন এমডি এ কাজ করেন।সম্প্রতি অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়সহ ১১টি কর্পোরেট শাখা সরেজমিন পরিদর্শন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া বাকি ৯১৯টি শাখার কার্যক্রম সম্পর্কে অগ্রণী ব্যাংকের দেয়া তথ্য বিশদ প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।জানা গেছে, এভাবে রূপগঞ্জ ট্রেডিংয়ের নামে ঋণ অনুমোদনের পর এ প্রতিষ্ঠানের তুলা আমদানির জন্য এলসিও খোলে অগ্রণী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখা। ৫৯ কোটি ৫১ লাখ টাকার তুলা আমদানির অর্থ ব্যাংক এলটিআর (লোন অ্যাগেনস্ট ট্রাস্ট রিসিপ্ট) হিসেবে দেয়। অথচ আমদানি করা তুলা বিক্রি করে ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ না করলেও নতুন করে আরও এলটিআর দেয়া হয়।এভাবে ১৩টি এলটিআর ঋণ সুবিধা নিয়েছে ওই প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কোনো এলটিআরের অর্থই সময়মতো পরিশোধ করেনি। স্বাভাবিকভাবে ঋণখেলাপি হয়ে পড়ে রূপগঞ্জ টেডিং। এরপর ৫ দফা তাদের ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের কোনো পণ্য মজুদ আছে কি-না তাও দেখা হয়নি।এসব ঋণ অনুমোদনের সময় অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন সৈয়দ আবদুল হামিদ। নানা অনিয়মের অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে গত বছরের ৩০ জুন অপসারণ করে। ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করেছে দুদক।ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ঋণ অনুমোদনের ফরমে কিছু ঘর খালি থাকতে পারে। কিন্তু নিয়মের বাইরে বা প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই ছাড়া ঋণ বিতরণের কোনো সুযোগ নেই।জানা গেছে, রূপগঞ্জ ট্রেডিংয়ের মালিক মোজাম্মেল হক ভূঁইয়া। মুঠোফোনে তার সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। প্রতিবেদকের পরিচয় দিয়ে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও সাড়া দেননি তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা গেছে, শুধু যাচাই-বাছাই ছাড়া ঋণ মঞ্জুর নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঋণ পুনঃতফসিলেও নিয়ম-কানুন মানা হয়নি। খেলাপি হওয়ার পরও কয়েকজন গ্রাহককে ঋণখেলাপি হিসেবে দেখানো হচ্ছে না।পরিদর্শন প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, তানাকা ট্রেডকম ইন্টারন্যাশনাল ও এইচএ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ব্যবসায়িক ঠিকানা যাচাই না করে ঋণ মঞ্জুর, বিতরণ, নবায়ন ও পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এলটিআরের মাধ্যমে দেয়া ঋণখেলাপি হলে তা খেলাপি না দেখিয়ে নতুন করে এলটিআর দেয়া হয়েছে।এমনকি এ প্রতিষ্ঠানকে সীমার চেয়ে বেশি অর্থ তোলার সুযোগ দিয়েছে ব্যাংক। এ দুই প্রতিষ্ঠানের ঋণের অর্থ সুইস কোয়ালিটি পেপার (বিডি) লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানে নেয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ব্যাংকের ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স (আইসিসি) বিভাগের আপত্তি সত্ত্বেও মারহাবা সিনথেটিকস মিলস লিমিটেডকে তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঋণ অনুমোদন করেছেন। পরে প্রতিষ্ঠানটি খেলাপি হলেও ৫ বার তাদের ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। বারবার এলসি করার সুযোগ দেয়া হয়। সবশেষে আমদানি করা মালামাল যাচাই না করে ডিমান্ড লোনের অনাদায়ী ৭৩ কোটি ২১ লাখ টাকা পুনঃতফসিল করা হয়েছে।সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, পরিদর্শনে যা উঠে এসেছে তা হওয়ার কথা ছিল না। এতে বোঝা যাচ্ছে কোনো নিয়ম পরিপালন করা হয়নি।
অগ্রণী ব্যাংকে ভয়াবহ ঋণ জালিয়াতি ও প্রতারণার ঘটনা
Share!