Monday , 23 December 2024
সংবাদ শিরোনাম

হজরত মুহাম্মাদ (সা.) সর্বদাই তার মানসিকতা ছিল যুদ্ধ নয় শান্তি চাই

হজরত মুহাম্মাদ (সা.) হচ্ছেন গোটা বিশ্ববাসীর জন্য মহান আল্লাহতায়ালার অপার রহমত। রাহমাতুল্লিল আলামিন- বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হয়ে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর অস্তিত্ব, তাঁর আনিত দ্বীন শরিয়ত তার প্রতিটি কথা কাজ আচার-আচরণ তার গোটা জীবনটাই শুধু মানবতাই নয় পুরো সৃষ্টির জন্য রহমত। পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট ইরশাদ হয়েছে, আমি তো আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমত বানিয়েই পাঠিয়েছি। (আম্বিয়া : ১০৭)
যুগ যুগ ধরে মারামারি, হানাহানি, খুন-খারাবি ও যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত অশান্ত পৃথিবীতে হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্মের মাধ্যমে যেন অপূর্ব রহমতের বারি বর্ষিত হয়েছিল। শত বছর যুদ্ধে জড়িয়ে যে আরববাসীর জীবন বিষিয়ে উঠেছিল হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আগমনে তারা পেয়েছিল কাঙ্ক্ষিত শান্তির সন্ধান। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, স্মরণ করো তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু। তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে।… (আল ইমরান ১০৩) অন্যত্র ইরশাদ করেন এবং তিনি তাদের পরস্পরের হৃদয়ে প্রীতি স্থাপন করেছেন। পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ ব্যয় করেও তুমি তাদের হৃদয়ে প্রীতি স্থাপন করতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহতায়ালা তাদের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করেছেন। (আনফাল ৬৩)।হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এমনই রহমতের আধার ছিলেন যে, সব সৃষ্টিকেই ভালোবাসতে শিখিয়েছেন তিনি। নবী (সা.) বলেন, সমগ্র সৃষ্টি মহান আল্লাহর পরিবারতুল্য। সুতরাং আল্লাহর পরিবারতুল্য সৃষ্টির সঙ্গে যে ভালো ব্যবহার করে সেই তার কাছে সর্বাধিক প্রিয়।
কিন্তু যিনি সমগ্র বিশ্বজগতের প্রতি আল্লাহর রহমত তিনি কী করে তাঁর জীবনে এতগুলো যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন? কী করে তিনি ও তাঁর অনুসারীরা এত রক্তপাত করেছিলেন?
এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, হজরত মুহাম্মাদ (সা.) সব সময় যুদ্ধকে এড়িয়ে চলতে চেয়েছেন। সর্বদাই তার মানসিকতা ছিল ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’। মহান আল্লাহতায়ালাই তাকে এ মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, তারা যদি তোমাদের থেকে সরে দাঁড়ায় তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ না করে তোমাদের সঙ্গে শান্তি প্রস্তাব করে তবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো পথ রাখেননি। (নিসা : ৯০) অনত্র ইরশাদ হয়েছে, তারা সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়লে তুমিও সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়বে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করবে। (আনফাল : ৬১) হজরত মুহাম্মাদ (সা.) হজরত আলী (রা.) কে একটি যুদ্ধাভিজানে পাঠানোর সময় এ উপদেশ দিয়ে পাঠিয়েছিলেন- তুমি শত্রু সৈন্যকে প্রথমেই ইসলামের দাওয়াত দেবে। তারা ইসলাম গ্রহণ করলে তাদের জানিয়ে দেবে যে, দিবারাত্রিতে তাদের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ। আর ইসলাম গ্রহণ না করলে তাদের ইসলামী রাষ্ট্রে কর দিয়ে শান্তিতে নিরাপদে বসবাসের প্রস্তাব দেবে। এসব কিছু থেকেই সুস্পষ্ট হয়, হজরত মুহাম্মাদ (সা.) সর্বদাই যুদ্ধ নয় শান্তি চেয়েছেন। একান্ত বাধ্য হয়ে উপায়ান্তর না দেখে তিনি যুদ্ধে জড়িয়েছেন। আর যুদ্ধ ক্ষেত্রেও তাঁর রাহমাতুল্লিল আলামিন গুণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। তার যুদ্ধনীতিও ছিল জগৎবাসীর জন্য রহমত।
আজকের দুনিয়ায় যুদ্ধগুলোতে সামরিক-বেসামরিক, দোষী-নির্দোষ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাইকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। রাতের আঁধারে ঘুমন্ত মানুষের ওপরও আক্রমণ করা হয়। হাসপাতাল, উপাসনালয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবকিছুই ধ্বংস করা হয়। কিন্তু হজরত মুহাম্মাদ (সা.) কখনও এ ধরনের আক্রমণ ও নির্বিচারে গণহত্যা করতেন না। তার নীতি ছিল যারা যুদ্ধ বা সৈনিক তাদের সঙ্গেই কেবল যুদ্ধ করা এবং জাগ্রত অবস্থায় দিনের বেলা আক্রমণ করা। তিনি রাতের আঁধারে ঘুমন্ত অবস্থায় শত্রু সৈন্যের ওপর আক্রমণ করতেন না। কোনো অভিযানে সৈন্য বাহিনী পাঠালে তাদেরও রাতের আঁধারে শত্রুদের ওপর আক্রমণ করতে নিষেধ করতেন। কারণ এতে দোষী-নির্দোষ, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নির্বিশেষে সবাই মারা যেতে পারে। হজরত মুহাম্মাদ (সা.) প্রকাশ্য সামনাসামনি শত্রুদের ওপর আক্রমণ করতেন। কোনো বাহিনীকে অভিযানে পাঠালে তাদেরও সেই উপদেশ দিয়ে পাঠাতেন হজরত মুহাম্মাদ (সা.)।
নারী শিশু বৃদ্ধ পঙ্গু সাধু সন্ন্যাসী যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সক্রিয় নয় তাদের হত্যা করতে কঠোরভাবে নিষেধ করতেন। হজরত রাবাহ ইবনে রাবী (রা.) বলেন, কোনো এক যুদ্ধে আমরা রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি কোনো এক স্থানে লোকদের জটলা দেখতে পেলেন। তখন তিনি সেখানে লোকদের সমবেত হওয়ার কারণ জানার জন্য এক ব্যক্তিকে পাঠালেন। তিনি ফিরে এসে জানালেন, শত্রুদের এক নারী নিহত হয়েছে। তাকে দেখার জন্য লোকেরা ভিড় করেছেন। তখন রাসূল (সা.) বললেন, এই মহিলা তো যুদ্ধ করার মতো ছিল না। মুসলিম বাহিনীর অগ্রভাগে তখন হজরত খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রা.) ছিলেন। রাসূল (সা.) এক ব্যক্তিকে এই বলে পাঠালেন, খালিদকে গিয়ে বল- কোনো নারী বা মজদুরকে হত্যা করো না। (আবু দাউদ : ২/৩৬২) হজরত ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, কোনো এক যুদ্ধে শত্রুপক্ষের এক নারীকে নিহত অবস্থায় পাওয়া গেল। এরপর রাসূল (সা.) নারী ও শিশুদের হত্যা করতে নিষেধ করে দিলেন। (বুখারি ১/৪৩০)।
হজরত মুহাম্মাদ (সা.) যুদ্ধের ময়দানে শত্রুদের অঙ্গ বিকৃত করতেও নিষেধ করেছেন।
যুদ্ধবন্দিদের প্রতি উদারোচিত আচরণেও হজরত মুহাম্মদ (রা.)-এর রাহমাতুল্লিল আলামিন গুণের পরিচয় পাওয়া যায়। বদরযুদ্ধের সত্তর জন বন্দিকে তিনি মুক্তি দিয়েছিলেন। বন্দি অবস্থায়ও তিনি তাদের প্রতি দয়াপরবশ আচরণ করতেন। তাদের পোশাক-পরিচ্ছদের আয়োজনও করতেন। তাদের খাবারের জন্য সাহাবাদের মাঝে তাদের বণ্টন করে দেন। সাহাবায়ে কেরাম নিজেরা খেয়ে-না খেয়েও তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন। হুনাইন যুদ্ধের ছয় হাজার বন্দিকেও তিন কোনো মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি দিয়েছিলেন। যুদ্ধবন্দিদের প্রতি নির্যাতন-নিপীড়নের কোনো একটি ঘটনাও রাসূল (সা.) পরিচালিত যুদ্ধগুলোতে পাওয়া যাবে না।
বিজিতদের সঙ্গে আচরণেও হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর রাহমাতুল্লিল আলামিন গুণের পূর্ণ পরিচয় মেলে। যে মক্কাবাসী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ও তার সহাবায়ে কেরামের ওপর সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছিল তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল, স্বদেশ ছাড়া করেছিল, সেই মক্কায় যখন তিনি বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করলেন তখন তিনি তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন।
বিজিতদের প্রতি এমন রহমত ও দয়াসুলভ আচরণের দ্বিতীয় আরেকটি দৃষ্টান্ত গোটা মানব ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে কি?
হজরত মুহাম্মদ (সা.) জীবনে অনেক যুদ্ধ করেছেন বটে। তবে সেসব যুদ্ধ আজকের যুগের মতো নয়। আজকের যুদ্ধ প্রথমতই অন্যায় যুদ্ধ হয়ে থাকে। যুদ্ধ করবে সামরিক বাহিনীর লোকেরা। বেসামরিক লোকদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু কেন সাব্যস্ত করা হবে? তা ছাড়া নারী-শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করা পৈশাচিক বিষয়। আজকের পৃথিবীতে সেটাই হচ্ছে অহরহ। এভাবে হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর যুদ্ধনীতি বিস্তারিত পর্যালোচনা করলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার রাহমাতুল্লিল আলামিন গুণের প্রতিফলন পাওয়া যায়।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top