মিয়ানমারে হত্যা, ধর্ষণ আর নিপীড়ন থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম। মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর অমানবিক নির্যাতনে মরছে রোহিঙ্গারা। বিপন্ন সেখানকার মানবতা। তাই নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা।গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। সিএনএনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, অনেক রোহিঙ্গা নারী সেনাবাহিনীর ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তারা নিজেদের চোখের সামনে বাড়িঘর পুড়ে যেতে দেখেছেন। তাদের পরিবারের লোকদের চোখের সামনে হত্যা করা হচ্ছে। অথচ তারা কিছুই করতে পারছেন না। বরং নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে সবকিছু ছেড়ে পালানো ছাড়া তাদের কাছে আর কোনো উপায় নেই। অথচ বিশ্ববিবেক নীরব।
লালু বেগম নামের এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, ‘১০ বছরের বেশি বয়সী কোনো ছেলেকে পেলেই হত্যা করছে সেনারা। বহু রোহিঙ্গা পুরুষকে ধরে নিয়ে গেছে সেনাবাহিনী। তাদের কী পরিণতি হয়েছে- তা কেউ জানে না।’তিনি আরও জানান, ‘যখনই সেনারা আসে আমরা বাড়িঘর ছেড়ে অন্য কোথাও পালিয়ে থাকি। সেনারা আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে। আমি এখনো জানি না আমার স্বামী বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন।’
আরেক রোহিঙ্গা নারী সফুরা বেগম বলেন, ‘মিয়ানমারের আগের (জান্তা সরকার) সরকারের সময়ও অত্যাচার ছিল। তবে এবারের মতো এত ভয়াবহতা আর কখনো দেখিনি। হঠাৎ করেই সেনাবাহিনী একেকটি গ্রাম ঘিরে ফেলে। একের পর এক বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পালানোর সময় মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। মেয়েদের ধরে ধরে নির্যাতন করে। এদের (সেনাবাহিনীর) হাতে মরতে চাই না। মৃত্যু হলে বাংলাদেশে মুসলিমদের হাতেই হোক। এখানে অন্তত জানাজা পড়ার মানুষ তো পাব!’ ছফুরা (বয়স আনুমানিক ৬০ বছর) জানান, তার বাড়ি মিয়ানমারের আকিয়াব জেলার মংডু উপজেলার কেয়ারিপাড়া গ্রামে। ওই গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ৪৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন তিনি। দু’দিন আগে আশ্রয় নিয়েছেন উখিয়া উপজেলার কুতুপালং আন-রেজিস্টার্ড শরণার্থী ক্যাম্পে।
ছফুরা বেগম বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগে বাড়ি ছেড়ে বের হই। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে লুকিয়ে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছি।’তিনি জানান, পাঁচ ছেলে এক মেয়ে আছে তার। স্বামী মারা গেছেন সাত বছর আগে। মিয়ানমারের নাগরিকতার স্বীকৃতি না পেলেও আরও অনেকের মতো ভালোই চলছিল তার সংসার। প্রায় এক সপ্তাহ আগে ওই সংসারে নেমে আসে কালো ছায়া। ওইদিন দুপুরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর একটি দল বাড়িতে ঢুকে তার একমাত্র মেয়েকে নির্যাতন করে। পরে বাড়িতে থাকা আসবাবপত্র তছনছ করে আগুন ধরিয়ে দেয়। চলে যাওয়ার সময় সেনাবাহিনী তার দুই ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তারা আর বাড়ি ফিরে আসেনি। কোনো উপায় না দেখে অন্যদের মতো বাংলাদেশে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন, জানিয়ে কেঁদে ফেলেন ছফুরা। তিনি জানান, ‘তিনি তার তিন ছেলে ও একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন।’তিনি বলেন, ‘জীবনে ৬০টি বছর পার করলেও কখনো বাংলাদেশে আসিনি। আমাদের কোনো আত্মীয়-স্বজনও এখানে আসেনি। মেয়েটার ওপর সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতনের কথা মনে হলে শরীর এখনো শিউরে ওঠে। এ কারণে প্রাণ বাঁচাতে ছুটে এসেছি এই দেশে।’বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করতেই আরেক বিপদে পড়েন বলে জানান ছফুরা। নাফ নদীতে ঘাট মাঝিকে মাথাপিছু মিয়ানমারের মুদ্রায় ১২ হাজার টাকা দিয়ে এপারে আসেন তারা। নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশের তীরে ভেড়ার পর স্থানীয় দালালদের খপ্পরে পড়েন। কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে বাংলাদেশি এক হাজার টাকা করে হাতিয়ে নেয় দালালরা। শরণার্থী ক্যাম্পে আসা পর্যন্ত সব হারিয়ে ছফুরা এখন নিঃস্ব। প্রাণে বেঁচে আছেন সান্ত্বনা এতটুকুই।গত এক সপ্তাহে ছফুরার মতো হাজারও রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং আন-রেজিস্টার্ড শরণার্থী ক্যাম্পে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভয়াবহ নির্যাতনের কথা। ছফুরা বেগমের সঙ্গে আসা ও ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া কবির আহম্মদ (৩৫), ফজল করিম (৪২), শফিক আহম্মদ (২৮), আব্দুর রশিদ (৩২), ছেমন বাহার (২০), আনোয়ারা বেগম (১৮), গোলবাহার (৭৫) জানান, মিয়ানমার সরকার যেভাবে মুসলমানদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যাকা-ের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাতে আরাকান রাজ্য শিগগিরই মুসলিমশূন্য হয়ে পড়বে।তারা আরও জানান, মিয়ানমার সেনাবাহিনী স্থানীয় যুবকদের হাত-পা বেঁধে মাথা নিচু করে গুলি করে হত্যা করছে। এসব কাজে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে কিছু রাখাইন যুবক। তাদের অত্যাচার সেনাবাহিনীর চেয়েও জঘন্য বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গারা।
এদিকে, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রধান জন ম্যাকইসিক অভিযোগ করেছেন, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন অভিযান চালাচ্ছে। বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী।’গত ৯ অক্টোবর সশস্ত্র একদল দুর্বৃত্ত মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকার একাধিক পুলিশ চেকপোস্টে হামলা চালিয়ে নয়জনকে হত্যার পর অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। মুসে ও কুটকাই শহরের সেনা চৌকি, পুলিশ স্টেশন ও একটি ব্যবসা কেন্দ্রে ওই হামলা চালানো হয়। নিহতদের মধ্যে এক সেনা, তিন পুলিশ, স্থানীয় এক নিরাপত্তাকর্মী ও তিন বেসামরিক নাগরিক ছিলেন।ওই হামলার প্রতিশোধ নিতে ওই এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়। তবে ওই এলাকায় সেনাবাহিনীর সহিংসতার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে সরকার।
মিয়ানমারের কর্মকর্তারা বলছেন, উত্তরাঞ্চলের রাখাইনে রোহিঙ্গারা নিজেদের বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে। সেনাবাহিনী সেখানে কোনো ধরনের নিপীড়ন চালায়নি। তবে দেশটির কর্মকর্তাদের এসব তথ্যের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কারণ মিয়ানমার সেনাবাহিনী ওই এলাকায় সাংবাদিক ও ত্রাণকর্মীদের প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। তাই প্রকৃত ঘটনা যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে যারা ওই এলাকা থেকে পালিয়ে আসছে, তাদের দাবি সেনাবাহিনীর অত্যাচারেই তারা পালাতে বাধ্য হচ্ছে।লালু বেগম বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় কুতুপালং ক্যাম্পে রয়েছেন। তিনি সিএনএনকে জানান, তাদের গ্রামের বহু নারীকে ধর্ষণ করেছে সেনারা। তিনি বলেন, ‘যখনই কোনো নারীকে সেনাদের পছন্দ হতো, তখনই তারা পানি খাওয়ার কথা বলে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে এবং নারীদের ধর্ষণ করে। তাদের ভয়ে পালিয়ে থাকছে রোহিঙ্গা নারীরা।’রাখাইন রাজ্যে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বাস করে। তবে মিয়ানমার সরকার এ রোহিঙ্গা মুসলিমদের তাদের দেশের জনগোষ্ঠী বলে স্বীকৃতি দেয় না। তারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসী বলে মনে করে।
দেশ থেকে পালিয়ে আসার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লালু বেগম বলেন, ‘যখন সেনারা আমাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল আমরা সেখান থেকে পালিয়ে অন্য গ্রামে আশ্রয় নিলাম। এরপর প্রতিনিয়ত আমরা এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে গেলাম। এরপর গভীর রাতে নাফ নদী হয়ে বাংলাদেশে এলাম। আমরা প্রায় চার দিন ধরে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে পালিয়ে বেড়িয়েছি।’তবে এভাবে পালাতে গিয়ে অনেকেরই পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু হয়েছে বা নিখোঁজ হয়ে গেছে। নাফ নদী পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকাডুবিতেও অনেক রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে বলে জানালেন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা অনেকেই।
অ্যামনেস্টির বিবৃতি এদিকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে বলছে, মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের সমষ্টিগতভাবে শাস্তি দিচ্ছে। এ থেকে বাঁচতে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করলে তাদের পুশ-ব্যাক করছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ।
বিবৃতিতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ- দুই দেশের আচরণকেই ‘নিষ্ঠুর’ আখ্যা দিয়ে অ্যামনেস্টি বলছে, এটি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।বিবৃতিতে সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পরিচালক চম্পা প্যাটেল বলেছেন, মিয়ানমার থেকে আসা মানুষেরা, যারা নাফ নদীতে বা ভূমিতে আত্মগোপন করে আছে, তারা খাবার, পানি এবং জরুরি চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলে অ্যামনেস্টি জানতে পেরেছে, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গা পুরুষদের হত্যা করছে, নারীদের ধর্ষণ করছে, বাড়িঘরে অগি্নসংযোগ এবং লুটতরাজ চালাচ্ছে।সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, এরই মধ্যে অন্তত দুই হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে আশপাশের গ্রামে, শরণার্থী শিবিরে এবং বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে। যে কারণে তাদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন মিজ প্যাটেল।
মিয়ানমারে হত্যা, ধর্ষণ আর নিপীড়ন থেকে বাঁচতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমবাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে
Share!