মিয়ানমার থেকে হিমায়িত মাছ, শুঁটকি, কাঠ, আদা, হলুদ, বরই, সুপারি, বাঁশ, বেত, আচার, সেনেকা মাটি, চিংড়ি আমদানি হয়। এতে ওই দেশের ব্যবসায়ীরা আয় করছেন শত শত কোটি ডলার। অন্যদিকে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা সীমান্ত বাণিজ্যে সুবিধা করতে পারছেন না। মিয়ানমারের অসহযোগিতায় সেখানে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার সৃষ্টি করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমেই বাড়ছে।
এদিকে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমারে রপ্তানি হচ্ছে গেঞ্জি, থানকাপড়, অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিক সামগ্রী, কোমল পানীয়, চানাচুর, বিস্কুট, সিমেন্ট, ওষুধ, প্রসাধন সামগ্রী, নারীর মাথার চুল প্রভৃতি। এসব পণ্যের বাজার মিয়ানমারে রয়েছে। কিন্তু বাজার ধরা যাচ্ছে না। ফলে আশানুরূপ বাণিজ্য বাড়ছে না। তাই সার্বিক বাণিজ্য লেনদেন বাংলাদেশের অনুকূলে নয়। ২১ বছর ধরে এভাবেই চলছে।
মিয়ানমারের সঙ্গে সরাসরি সীমান্ত বাণিজ্যের একমাত্র বন্দর হলো টেকনাফ স্থলবন্দর। স্থলবন্দর হলেও আসলে বাণিজ্য হয় নৌপথে। নাফ নদীই দুই দেশের সীমান্ত চিহ্নিত করেছে। তাই মালামাল এপার-ওপার নৌপথেই।
টেকনাফ শুল্ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ বছরে মিয়ানমার থেকে আমদানি হয়েছে ৩ হাজার ৬১৮ কোটি ৬২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৬৪ টাকার পণ্য। আর একই সময়ে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ১৭৫ কোটি ১৬ লাখ ১০ হাজার ৪৩৮ টাকার পণ্য। বাণিজ্য ঘাটতি ৩ হাজার ৪৪৩ কোটি ৪৬ লাখ ৭৩ হাজার ১২৬ টাকা। যদিও ২১ বছরে টেকনাফ স্থলবন্দরের আয় হয়েছে ৯৮৩ কোটি ৭৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩২৫ টাকা। গত আগস্ট মাসে মিয়ানমার থেকে পণ্য আমদানি হয়েছে ৪৪ কোটি ১ লাখ ৯৮ হাজার ৩৩৬ টাকার। আর টেকনাফ থেকে মিয়ানমারে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ২ কোটি ৬০ লাখ ২৫ হাজার ৯২১ টাকার পণ্যসামগ্রী। এই হিসাবে আগস্ট মাসেই বাণিজ্য ঘাটতি ৪১ কোটি ৪১ লাখ ৭২ হাজার ৪১৫ টাকা। এ বাণিজ্য ঘাটতি দূর করার উপায় খুঁজে বের করতে আজ সোমবার কক্সবাজারে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ-মিয়ানমার বর্ডার ট্রেড জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’-এর সদস্যরা বৈঠকে বসবেন। সূত্রগুলো বলছে, বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে ‘সীমান্তবাজার’ চালুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হতে পারে। টেকনাফ সীমান্ত বাণিজ্যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে মিয়ানমার চেম্বারের ১৪ সদস্যবিশিষ্ট ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল গতকাল রোববার বিকেলে টেকনাফ পৌঁছেছে। আজ কক্সবাজার চেম্বারের নেতাদের সঙ্গে ওই ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলের যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হবে। কাল মঙ্গলবার মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শন এবং চট্টগ্রাম চেম্বারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে ৩০ সেপ্টেম্বর ফিরে যাবে।
স্থলবন্দরের আমদানিকারক আবুল হাশেম বলেন, মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পণ্য টেকনাফ বন্দরে খালাসের পর ট্রাক বোঝাই করে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা পণ্য মিয়ানমারের মংডু ছাড়া আর কোথাও পাঠানোর ব্যবস্থা নেই। তিন দিনের পাস নিয়ে মিয়ানমারের ব্যবসায়ীরা টেকনাফ এসে চট্টগ্রাম পর্যন্ত চলে যান। আর বাংলাদেশিরা মিয়ানমার গিয়ে মংডু শহরের বাইরে যেতে পারেন না। ফলে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সেখানে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার সৃষ্টি করা যাচ্ছে না।
ব্যবসায়ীরা জানান, ২০১২ সালে মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর থেকে সীমান্ত বাণিজ্যে ভাটা পড়েছে। ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সেখানে কড়া নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। এখন মংডুতে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা কম। বন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হকের মতে, মিয়ানমার সরকার সে দেশে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার সৃষ্টির সুযোগ না দিলে টেকনাফ সীমান্ত বাণিজ্যে ঘাটতি লেগেই থাকবে। গতকাল দুপুরে স্থলবন্দর ঘুরে দেখা গেছে, নাফ নদী অতিক্রম করে তিনটি কাঠের ট্রলার বোঝাই করে মিয়ানমার থেকে আমদানি হয়েছে হিমায়িত মাছ, শুঁটকি ও আচার। শ্রমিকেরা ট্রলার থেকে কাঁধে করে সেই মালামাল বন্দরে খালাস করছেন।জানা গেছে, টেকনাফ বন্দর দিয়ে মিয়ানমারে রপ্তানি হচ্ছে নারীর মাথার চুল। কয়েকজন ব্যবসায়ী দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লম্বা চুল সংগ্রহ করে তা মিয়ানমারে রপ্তানি করছেন। প্রতি মণ চুলের দাম ৫০-৭০ হাজার টাকা। ২০১৫ সালে প্রায় ১০০ কোটি টাকার কাঠ আমদানির বিপরীতে সরকারকে প্রায় ১০ কোটি টাকার রাজস্ব দিয়েছেন ব্যবসায়ী সাইফুল করিম। তিনি বলেন, স্থলবন্দরকে নৌবন্দরে উন্নীত করতে হবে। পণ্য খালাসের জন্য বন্দরে অন্তত ১০টি জেটি নির্মাণ এবং শ্রমিক দিয়ে পণ্য খালাসসহ বন্দর কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত চার্জ আদায় বন্ধ করতে হবে।টেকনাফ স্থলবন্দরটি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ বিল্ড ওউন অপারেট ট্রান্সফার (বিওওটি) পদ্ধতিতে এ বন্দরটি পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট লিমিডেট নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক আবু নুর খালিদ জানান, বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়নে এ পর্যন্ত তাঁরা ৩৪ কোটি টাকা ব্যয় করেছেন। সীমান্ত বাণিজ্য গতিশীল করতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশের টেকনাফের সঙ্গে ব্যবসা করে লাভবান হচ্ছেন মিয়ানমারের ব্যবসায়ীরা
Share!