কলকাতার ছবিতে অভিনয় করার সময় গ্রামের দৃশ্যের শুটিংয়ের জন্য প্রায়ই আমাদের বোলপুর যেতে হয়। যাওয়ার পথেই পরে শক্তিগড় নামের জায়গাটা। কলকাতা থেকে বর্ধমানের দিকে যেতে আড়াই বা তিন ঘণ্টার পথ। বোলপুরে যাওয়ার পথে সবাই শক্তিগড়ে যাত্রাবিরতি নেয়। রাস্তার দুই পাশে অসংখ্য মিষ্টির দোকান। সেখানেই পাওয়া যায় ল্যাংচা নামের একটা বিখ্যাত মিষ্টি। গাড়ি থামিয়ে গরম-গরম ল্যাংচা মিষ্টি খায় সবাই।আমি প্রথম ওই দিকটায় যাই ২০০২ সালের শীতে। একটা অনুষ্ঠান ছিল। জায়গাটা ল্যাংচার জন্য বিখ্যাত। কুমিল্লায় যেমন মাতৃভান্ডারের ছড়াছড়ি। ওখানেও তেমন অনেক ল্যাংচার দোকান। আদি ল্যাংচা ঘর, গণেশের ল্যাংচা, নিউ ল্যাংচা। দোকানগুলোতে ঢুকলে ওরা বলে, এখানে সৌমিত্র থেকে শুরু করে ভিক্টর ব্যানার্জীরা নিয়মিত আসেন। শুটিংয়ের জন্য ওই পথ ধরে যাওয়ার সময় অভিনয়শিল্পীরা এলেই সেখানে নেমে ল্যাংচা খান। আমাদের দেশে ল্যাংচা হয়তো সেভাবে পরিচিত নয়। এই মিষ্টি অনেকটা আমাদের কালোজামের মতো। তবে একটু লম্বা আর বড়। ভেতরে খানিকটা এলাচ দানার ঘ্রাণ। ১৫, ২০, ১০০ টাকা করে দাম। পিস ও কেজি হিসেবে বিক্রি হয়।
প্রিয় খাবারের তালিকায় ঢুকে গেল ল্যাংচা
আমি যতবারই ওই দিক দিয়ে যেতাম, দোকানটাতে ঢুকতাম। ওরা জানত আমি বাংলাদেশের নায়ক, দুই বাংলার ছবিতেই কাজ করি। তাই আমাকে খুব আপ্যায়ন করতসেখানকার বেশির ভাগ দোকানই খোলা থাকে অনেক রাত পর্যন্ত। কিছু দোকান বুন্দিয়া বানায়। এখন হয়তো নতুন আরও অনেক কিছু যুক্ত হয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রায়ই আমাকে দুর্গাপুর যেতে হয়। যাওয়ার পথে শক্তিগড়ে থামি। সেখান থেকে ল্যাংচা আর চা খেয়ে তারপর আবার যাত্রা শুরু করি। এক রাতে বোলপুর থেকে ফিরছিলাম। পরের দিন ঢাকায় ফেরার কথা। ভাবলাম বাসার জন্য কিছু ল্যাংচা নিয়ে যাই। বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। আদি ল্যাংচা ঘর বা এ রকম নামের একটা দোকানে ঢুকলাম। দোকানটি বেশ সুন্দর করে গোছানো। অনেক তারকার বাঁধাই করা ছবি দিয়ে দোকান সাজানো। রাত প্রায় আড়াইটা বেজে গিয়েছিল বলে দোকানটা একটু নিরিবিলি ছিল। আমি হাতমুখ ধুয়ে আসতেই দোকানের বেশ কয়েকজন আমাকে চিনে ফেলল। কাছে এসে কথা বলল। জানাল দোকানটা অনেক পুরোনো, এখানে উত্তমকুমার নিয়মিত ল্যাংচা খেতেন! কথাটা শুনে আমি আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম। কারণ, আমি উত্তমকুমারের ভীষণ ভক্ত। ওদের কাছে জানতে চাইলাম, তিনি কবে কোন ছবির শুটিংয়ের সময় এসেছিলেন। দোকানের লোকজন বেশ কিছু ছবির নাম বলল। পুরোনো অ্যালবাম বের করে দেখালো ওই দোকানে উত্তমকুমারের সাদাকালো ছবি। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই রোমাঞ্চকর মনে হলো। দোকানের ভেতরেও উত্তমকুমারের ছবি বড় করে বাঁধানো, তাতে ফুলের মালা দেওয়া। জানতে পারলাম, এই রাস্তা দিয়ে যত তারকা যান, সবাই এই দোকানে থেমে ল্যাংচা খান। এমনকি বুম্বাদাও (প্রসেনজিৎ) আসেন।এরপর থেকে আমি যতবারই ওই দিক দিয়ে যেতাম, দোকানটাতে ঢুকতাম। ওরা জানত আমি বাংলাদেশের নায়ক, দুই বাংলার ছবিতেই কাজ করি। তাই আমাকে খুব আপ্যায়ন করত। একসময় তাঁরা পরিবারের মতোই হয়ে গেল। তাঁরা আমার ছবিও তুলে রেখেছিল। আমার স্মৃতিতে বিষয়টি এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে। আমার চলচ্চিত্রজীবনের আদর্শ উত্তমকুমারের স্মৃতিঘেরা ওই জায়গায় খানিকটা সময় কাটাতে পারা আমার জন্য একরকম আশীর্বাদের মতো। এমনকি আমার প্রিয় খাবারের তালিকায়ও জায়গা করে নিয়েছে ল্যাংচা মিষ্টি।এমনিতেই আমি মিষ্টি খুব পছন্দ করি। মিষ্টি জাতীয় প্রায় সব খাবারই আমার পছন্দের। টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম আর সিরায় ডোবানো রসগোল্লা আমার সবচেয়ে প্রিয়। আরও আছে যশোরের পুরের সন্দেশ ও পাবনার পেয়ারা সন্দেশ। যদিও এসব খাওয়া খুব নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আমার মাও খুব মিষ্টি পছন্দ করেন, বিশেষ করে রসগোল্লা। বোলপুরে ঋতুপর্ণা ও রচনার সঙ্গে অনেকবার গিয়েছি। সেখানে নামলে ঋতু ল্যাংচা খাবেই। অন্য সময় হয়তো মিষ্টি খায় না, কিন্তু ওখানে গেলে সবাই ডায়েট করা ভুলে যায়। লোভ সামলাতে না পেরে একটা-দুটো মিষ্টি খেয়ে ফেলে। আমি ও ঋতু যতবারই ওই পথ দিয়ে গেছি, নেমে ল্যাংচা আর চা খেয়ে ফিরেছি।
Share!