সামরিক অভ্যুত্থান চেষ্টা তুরস্কে জনগণের শক্তির কাছে নস্যাৎ হয়ে গেছে। সামরিক বাহিনীতে গণগ্রেপ্তারের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায় ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সমাপ্তি। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার সমর্থক রাজপথে নেমে এলে ব্যর্থ হয়ে যায় ক্যু চেষ্টা। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সহ ২৮৩৯ সেনাসদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম। রাজধানী আঙ্কারা ও অন্যতম প্রধান শহর ইস্তাম্বুলে রাতভর গোলাগুলি ও সংঘর্ষে নিহত হয়েছে ১৬১ জন। এছাড়া ১০৪ জন অভ্যুত্থানকারী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৪৪০ জন। স্থানীয় রেডক্রিসেন্ট জানিয়েছে, প্রধান দু’শহরের হাসপাতালে সংঘাতে আহত প্রায় ১ হাজার জন ভর্তি হয়েছেন। এ দু’শহর ছাড়াও দেশের আরো কিছু জায়গায় গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।
বিবিসি’র খবরে বলা হয়েছে, স্থানীয় সময় শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে ঘটনাপ্রবাহ শুরু হয়। ইস্তাম্বুলের বসফরাস প্রণালীর ওপরের দু’টি ব্রিজে ট্যাংক অবস্থান নিতে শুরু করে। এতে বন্ধ হয়ে যায় যানচলাচল। সড়কে দেখা যেতে থাকে সৈন্যদের। পাশাপাশি নিচু হয়ে উড়তে থাকে সামরিক যুদ্ধবিমান। এর কিছুক্ষণ পরই সেনাবাহিনীর একটি অংশ বিবৃতি দিয়ে জানায়, ‘পিস কাউন্সিল’ দেশ চালাচ্ছে। বিবৃতিতে বলা হয়, দেশে ‘সাংবিধানিক শৃঙ্খলা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত ও পুনরুদ্ধারের’ জন্য এ অভ্যুত্থান শুরু করা হয়েছে। দাবি করা হয়, বর্তমান সরকারের হাতে গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার আইনের শাসন দুর্বল হয়েছে। তাই নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন চ্যানেল সহ প্রায় সব চ্যানেল দখলে নেয় সেনারা। সেখানে অভ্যুত্থানের পক্ষে বিবৃতি পড়ে শোনানো হয়। বন্ধ হয়ে যায় ইস্তাম্বুলের কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দর। পরে অবশ্য আবার চালু করে দেয়া হয়। বিবিসি’র খবরে বলা হয়েছে, এ অভ্যুত্থানের পেছনে কে ছিল, তা সপষ্ট নয়। তবে প্রেসিডেন্ট এরদোগান সপষ্টভাবে অভিযোগের আঙ্গুল তাক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক রহস্যময় তুর্কি ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনের দিকে। তবে এক বিবৃতিতে এ অভিযোগ সমপূর্ণভাবে অস্বীকার করেছেন গুলেন। তিনি বলেন, ‘তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থান চেষ্টার কড়া নিন্দা জানাই।’ প্রেসিডেন্ট এরদোগান ছিলেন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় মারমারিস অবকাশ যাপন কেন্দ্রে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে টেলিভিশনে প্রচারিত এক বার্তায় তিনি জনগণকে এ বিদ্রোহের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে আহ্বান জানান। এরপর তিনি ইস্তাম্বুলে চলে যান। মারমারিস ছাড়ার পর সেখানে বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে বলেও জানান তিনি। প্রেসিডেন্ট এরদোগান যখন ইস্তাম্বুলের কামাল আতার্তুক বিমানবন্দরে এসে নামেন হাওয়া পুরো ঘুরে গেলো। বিমানবন্দরে এক বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘যা চালানো হচ্ছে, তা রাষ্ট্রদ্রোহ ও বিদ্রোহ। তাদেরকে চড়া মূল্য চুকাতে হবে।’ তখন অনেকের কাছেই পরিস্কার হয়ে গেল যে, অভ্যুত্থানকারীরা ব্যর্থ হয়েছে। এরদোগানের ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার মানুষ তখন ইস্তাম্বুল এর রাস্তায় নেমে এসেছেন। বিমানবন্দরে যে সেনারা অবস্থান নিয়েছিল তাদের ঘেরাও করে জনতা পুরো বিমানবন্দর দখল করে নেয়। অভ্যুত্থানকারীদের নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ শিথিল হতে থাকে। মাইক ব্যাডিলি নামে মারমারিসে অবকাশ যাপনে থাকা এক বৃটিশ পর্যটক জানান, বড় বিস্ফোরণের শব্দে তিনি চমকে উঠেন। এরপর একটি বা দুইটি হেলিকপ্টার আকাশে চক্কর দিচ্ছিল। মেশিনগানের শব্দও শোনা যাচ্ছিল। সকালে তিনি সামরিক পোশাকে সশস্ত্র ব্যক্তিদের হোটেলের চারপাশে হাঁটতে দেখেছেন। তবে কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেনি। ওদিকে, তুর্কি পার্লামেন্ট ও আঙ্কারার প্রেসিডেন্ট ভবনে হামলা চালানো হয়। পার্লামেন্ট ভবনে অন্তত একটি বোমা হামলা চালানো হয়েছে। এমপিরা গোপনস্থানে লুকিয়ে ছিলেন তখন। ইস্তাম্বুল পুলিশ সদর দপ্তরের বাইরে বন্দুকযুদ্ধের আওয়াজ শোনা গেছে। ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরের বাইরে ট্যাংক মোতায়েন করা হয়েছিল। সংবাদ মাধ্যম সিএনএন’র সহযোগী সিএনএন টার্কের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করে বিদ্রোহী সেনারা। এরপর এ চ্যানেলের সমপ্রচার সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। এক টুইটে পরে চ্যানেলটি একটি ফটো শেয়ার করে। সেখানে দেখা যায়, পুলিশ বিদ্রোহী সেনাদের আটক করছে। ইস্তাম্বুলের কেন্দ্রে অবস্থিত তাকসিম স্কোয়ারে ব্যাপক সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। বন্দুকযুদ্ধ ও বিস্ফোরণের শব্দও পাওয়া গেছে। বিদ্রোহী সেনাদের একটি হেলিকপ্টার আঙ্কারার সরকারি বাহিনীর এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। সকালেও কিছু এলাকায় বিক্ষিপ্ত গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। প্রধানমন্ত্রী ইলদিরিম বলেছেন, বর্তমানে পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। সরকারের কমান্ডাররা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছেন। এর আগে ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান উমিত ডান্ডার বলেন, মূলত বিমানবাহিনী, সামরিক পুলিশ ও আর্মার্ড ইউনিটের কিছু কর্মকর্তা এ অভ্যুত্থান চেষ্টায় জড়িত। যদিও পরে প্রধানমন্ত্রী জানান, অভ্যুত্থানকারীদের অনেকে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা। তবে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা সরকারের প্রতি সপষ্ট সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রের বরাতে সিএনএন জানিয়েছে, সেনাবাহিনীর ৫ জেনারেল ও ২৯ কর্নেলকে পদচ্যুত করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হাইকোর্টের কিছু বিচারকের বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে। বিমানবাহিনীর অন্তত একটি ঘাঁটি এখনও বিদ্রোহীদের দখলে। প্রথমদিকে সেনাপ্রধানের অবস্থান সমপর্কে অসপষ্টতা থাকায় বিদ্রোহে তার সংশ্লিষ্টতা নিয়েও প্রশ্ন জাগে। তবে ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান জানান, সেনাপ্রধান বিদ্রোহী সেনাদের হাতে আটক হয়েছিলেন। পরে তাকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে বেশকিছু জ্যেষ্ঠ সামরিক কমান্ডারকে এখনও জিম্মি করে রেখেছে বিদ্রোহীরা। প্রায় ২০০ জন অস্ত্রহীন সেনা আঙ্কারায় তুর্কি সামরিক বাহিনীর সদরদপ্তর থেকে বের হয়ে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তাসংস্থা আনাদোলু এ খবর দিয়েছে। ওয়াশিংটনে তুরস্ক দূতাবাসের টুইটার অ্যাকাউন্টে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে প্রেসিডেন্ট প্যালেসের ভেতর বিদ্রোহী সেনাদের আটক করা হয়েছে। এর আগে বসফোরাস ব্রিজে তোলা কিছু ছবিতে দেখা গেছে, ডজন ডজন সেনা তাদের ট্যাংক থেকে হাত উঁচু করে বের হচ্ছে। এমনকি একদল সেনা হেলিকপ্টার নিয়ে প্রতিবেশী গ্রিসে গিয়ে আশ্রয় চেয়েছেন। এদেরকে ফেরত দিতে গ্রিসকে বলেছেন তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সরকার বলছে, এ অভ্যুত্থান অনেকদিন ধরে পরিকল্পনা করে ঘটানো হয়েছে বলে তারা মনে করেন না। সেনাবাহিনীর বাইরে দেশের বেসামরিক প্রশাসন ও কূটনীতিক মহলের মধ্যে বিদ্রোহীদের প্রতি কোনো ধরনের সমর্থন দেখা যায়নি। বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ তুর্কি কূটনৈতিক মিশনের কর্মকর্তারা এরদোগানের সরকারের পক্ষে সপষ্টতই অবস্থান নিয়েছেন। এছাড়া বিদেশি কোনো রাষ্ট্রও এ অভ্যুত্থানের প্রতি সমর্থন দেয়নি। ন্যাটো, জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন সহ প্রতিবেশী ইরান অভ্যুত্থানের প্রাক্কালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। এদিকে স্থানীয় সময় বেলা আড়াইটায় গণহারে এসএমএস বার্তা পাঠান এরদোগান। তিনি এ সময় আরেকটি অভ্যুত্থানের আশঙ্কা প্রকাশ করেন। বাইরে অবস্থানরত সমর্থকদের রাজপথ দখলে রাখার আহ্বানও জানান তিনি।
ক্যু অচেনা নয় তুরস্কে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেফ তাইয়েফ এরদোয়ানের সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান চেষ্টার পর সারা বিশ্বে আলোচনার শীর্ষে উঠে এসেছে এ ঘটনা। আপাতত, ব্যর্থই বলা চলে এ অভ্যুত্থানকে। কিন্তু তুরস্কের সামরিক বাহিনীতে সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান এটিই প্রথম নয়। দেশটির সেনাবাহিনী আগাগোড়া সেকুলার। তাই প্রায়ই ইসলামপন্থি বিভিন্ন দল বা সরকারের সঙ্গে বিরোধ লেগেই ছিল সামরিক বাহিনীর। এর আগে আরও পাঁচবার ক্যু ঘটেছে দেশটিতে। ১৯৬০: প্রায় রক্তপাতহীন এ সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিলেন ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারা ওয়্যার কলেজের কর্মকর্তা ও শিক্ষানবিশ কর্মকর্তারা (ক্যাডেট)। পরের দিন স্থলবাহিনীর প্রধান জেনারেল সিম্যাল গারসেল রাজনৈতিক সংস্কার দাবি করেন। কিন্তু তার দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়। তাই তিনি পদত্যাগ করেন। অভ্যুত্থানের নেতারা ৩৮ সদস্যবিশিষ্ট ন্যাশনাল ইউনিটি কমিটি গঠন করেন। ওই ঘটনার চেয়ারম্যান ছিলেন গারসেল। এ সময় বিচার হয় ৬০১ জনের, যাদের ৪৬৪ জনকেই বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। ১৯৭১: বামপন্থি ও জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে দীর্ঘ লড়াইয়ে দেশ বিপর্যস্ত। মাসের পর মাস চলছিল ধর্মঘট। রাজপথে প্রায়ই লড়াই চলছিল দুপক্ষের মধ্যে। এ সময় সামরিক বাহিনী সরকারকে আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের জন্য সতর্ক করে দেয়। কয়েক মাস পর প্রধানমন্ত্রী সুলেমান ডেমিরেল পদত্যাগ করেন। রক্ষণশীল রাজনীতিক ও আমলারা সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের পথ বেছে নেয়। ফলে বেশ কয়েকটি প্রদেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরের আগে সেনাশাসন সমপূর্ণভাবে প্রত্যাহার করা হয়নি। ১৯৮০: ওই বছরের ১২শে সেপ্টেম্বর জেনারেল কেনান ইভরেনের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কমান্ড অভ্যুত্থান পরিচালনা করে। এ ঘটনার পরপর আবারও রাজপথে সংঘাত বাধে বামপন্থি ও জাতীয়তাবাদীদের। শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিকদের গ্রেপ্তার করা হয়। পার্লামেন্ট, রাজনৈতিক দল ও সব ট্রেড ইউনিয়ন বিলুপ্ত করে দেয়া হয়। ৫ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ দেশের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে। সংবিধান বাতিল করে দেয়া হয়। প্রভিশনাল সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, যাতে প্রায় অসীম ক্ষমতা পান সামরিক কমান্ডাররা। ১৯৯৭: ওই বছরের ১৮ই জুন প্রধানমন্ত্রী নেকমেত্তিন এরবাকান পদত্যাগ করেন। প্রতিপক্ষরা তাকে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচিতির প্রতি বিপজ্জনক হিসেবে আখ্যায়িত করে। একপর্যায়ে সামরিক বাহিনী, ব্যবসায়ী, বিচার বিভাগ ও রাজনীতিবিদদের উপর্যুপরি চাপে এরবাকান পদত্যাগ করেন। মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ককে সুরক্ষিত করতে নিজেদেরই যোগ্য মনে করেন সেনাবাহিনীর জেনারেলরা। ২০০৭: লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা এরগেনেকোন গোষ্ঠী প্রথম নজরে আসে এ বছর। ইস্তাম্বুলের একটি ঘরে পুলিশি অভিযানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। শেষ পর্যন্ত শ’ শ’ মানুষকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রিসেফ তাইয়িফ এরদোগানের বিরুদ্ধে কথিত অভ্যুত্থান চেষ্টার দায়ে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। সাংবাদিক, কর্মকর্তা, আইনজীবীসহ ২৭৫ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তবে ২০১৬ সালে আপিল আদালত ওই আদেশ বাতিল করে দেন। আদালতের রায়ে বলা হয়, এরগেনেকোন নামে কোন গোষ্ঠীর অস্তিত্বই প্রমাণ করতে পারেনি সরকার।
সেনা অভ্যুত্থান নিহত ২৬৫ : গ্রেপ্তার ২৮০০
Share!