একের পর এক ভূমিকম্প হচ্ছে বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে। ভূমিকম্পে কাঁপছে বিশ্বের অন্যান্য দেশও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূগর্ভস্থ প্লেট পর্যালোচনায় বাংলাদেশ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সর্বশেষ বুধবার রাতে মিয়ানমারে হওয়া ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে সারা দেশ। এতে কোনো প্রাণহানি না হলেও দেশের কয়েকটি জায়গায় ভবন হেলে পড়েছে। ভূমিকম্পের মাত্রা সাত-এর উপরে হলে এই ক্ষয়ক্ষতি আরও বেশি হবে। সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীর ২৫ ভাগ ভবন ভেঙে পড়বে। এখনই সতর্ক না হলে বড় ভূমিকম্পে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে রাজধানী- এমন তথ্যই জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ২০১০ সালে চিলি ও হাইতিতে দুটি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয় ৮.৮ এবং ৭.৩ রিখটার স্কেলে। হাইতিতে মারা যায় প্রায় ৩ লাখ লোক। কিন্তু বেশি কম্পন হলেও চিলির ভূমিকম্পে মাত্র ৫০০ লোক মারা গিয়েছিল। চিলিতে এই হতাহতের সংখ্যা কম হওয়ার একমাত্র কারণ ছিল আগাম প্রস্তুতি। দেশটি ১৯৬০ সালে শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর ৫০ বছর তারা বিল্ডিং কোর্ড থেকে শুরু করে সকল জায়গায় আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ ও মনিটরিং করেছে।রানা প্লাজা ধসের পর রাজউকের উদ্যোগে ৩৫০০০ ভবনের মধ্যে মাত্র ৫ ভাগ ভবন ভূমিকস্প সহনীয় বলে পাওয়া গেছে। তার মানে বাকিগুলো ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। এই উদ্যোগটি এখন ঝিমিয়ে গেছে। এখন শুধু নতুন বিল্ডিং নয়, পুরনো বিল্ডিংগুলো পরীক্ষা করতে হবে।ভূবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীর ভূগর্ভস্থ প্লেট ও সাব-প্লেট দিয়ে গঠিত। এ রকম দুটি প্লেটের মাঝখানে যে ফাঁক থাকে, তাকে বলা হয় ফল্ট লাইন। বাংলাদেশ ও আশপাশে এমন পাঁচটি ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে। এগুলো হলো টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্ট লাইন, সিলেট ও ভারতের মেঘালয়ের মাঝে ডাউকি ফল্ট লাইন, কক্সবাজার-ফেনীর মাঝে প্লেট বাউন্ডারি-১, ফেনী-শ্রীমঙ্গলের মাঝে প্লেট বাউন্ডারি-২ ও ভারত ও শ্রীমঙ্গলের মাঝে প্লেট বাউন্ডারি-৩ ফল্ট লাইন। এর মধ্যে প্লেট বাউন্ডারি-৩ এর ফল্ট লাইনে গত বুধবার ভূমিকম্প হয়। উল্লিখিত পাঁচটির মধ্যে মধুপুর ফল্ট লাইন ঢাকার জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। রাজধানী ঢাকা থেকে এর দূরত্ব ৯০ কিলোমিটার। প্রায় ১৫ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত এ ফল্ট লাইন ঢাকায় ভূমিকম্পের অন্যতম কারণ হতে পারে। পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে ভূমিকম্পের ফলে মধুপুর ফল্টের পরিবর্তন আসার ঝুঁকি রয়েছে। এতে ওই এলাকার প্লেট বা সাব-প্লেট বিচ্যুত হলে তা ঢাকার জন্য বিপদ ডেকে আনবে।এবিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাংলাদেশে নতুন নয়, এটা অনেক বছর ধরে ছিল। ভবিষ্যতে থাকবে। কিন্তু আমরা যখন অপরিকল্পিত নগরায়ন করি তখন এই ঝুঁকিটা আরও বেড়ে যায়। ১৮৭০ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত আমাদের এখানে ৬টি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছিল। এবং কোনটাই ৭.১ মাত্রার নিচে ছিল না। সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮৯৭ সালে ৮.১ মাত্রায়। এতে সিলেটসহ কয়েকটি শহরে ১৫৪২ জন মানুষ মারা যায়। সেই সময় ঢাকায় ৯০ হাজার মানুষ ছিল, পাকা বাড়ি ছিল মাত্র ১০০-এর মতো। সেখানেই কয়েক শ’ মানুষ মারা যায়। আর এখন ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি। ভবন বেড়েছে কয়েক লাখ। এখন ৮.১ মাত্রায় ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত হবে বলে বলা দুরূহ। রাজউকের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ঢাকায় ৪ লাখ বাড়ি আছে। সাড়ে ৭ বা তার বেশি মাত্রায় ভূমিকম্প হলে রাজধানীর ২৫% বাসা বাড়ি ভেঙে পড়তে পারে, এতে ২-৩ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাঁচটি ফল্ট লাইনের মধ্যে ঢাকার জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির কারণ হবে মধুপুর ফল্ট লাইন। এ থেকে উৎপত্তি হওয়া ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূকম্পনে ৬ বিলিয়ন ডলার প্রত্যক্ষ ক্ষতি হবে। তবে পরোক্ষ ক্ষতি কত হবে তার কোনো হিসাব নেই। হালনাগাদ হিসাবে ঢাকার চার লাখ স্থাপত্যের ৩০ শতাংশ মাঝারি থেকে উচ্চমাত্রার ক্ষতির আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে।বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজউকের এলাকায় মোট বিল্ডিংয়ের ৬০% ও ঢাকা সিটি কপোরেশনের মধ্যে ৩০% বিল্ডিং দুর্বল বা নরম মাটির ওপর নির্মিত। তারা বলেন, ভূমিকম্প হলে, বালু দিয়ে যদি ভরাট করে তবে সেই বিল্ডিং বসে যাবে। আর যদি কাদা মাটি দিয়ে ভরাট করে তবে সেই বিল্ডিং অন্যদিকে হেলে বা ভেঙে যেতে পারে।নগর পরিকল্পনাবিদ খন্দকার এম আনসার হোসেন বলেন, নিম্নমানের মাটি ও জলাভূমি ভরাট করে গড়ে ওঠা শহরের বেশির ভাগ অংশ বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে। মিরপুর, কেরানীগঞ্জ, মোহাম্মদপুর, উত্তরা বালি বা আবর্জনার ওপর গড়ে ওঠেছে। এসব এলাকার ভবন ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি সহ্য করতে পারবে না। ফলে এসব এলাকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ক্ষতি থেকে বাঁচতে ভূমিকম্প সহনশীল ভবন নির্মাণের পাশাপাশি মাটির গুণাগুণ যাচাই করা জরুরি।নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ঝুঁকি কমাতে পরিকল্পিত নগর গড়ার কোনো বিকল্প নেই। একটা শহরে খোলা জায়গা যদি না থাকে তবে এই ঝুঁকি আরও বেশি হয়। ঢাকা শহরের অধিকাংশ বাড়ি পুকুর, বিল বা খালের ওপর।বাংলাদেশে ভূমিকম্পের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও রংপুর। মেহেদী আহমেদ আনসারীর মতে, আমাদের বিল্ডিংগুলো যদি কোড অনুযায়ী করা হয় তবে প্রথমে ৯০% মানুষ সুরক্ষিত হয়ে যায়। তিনি বলেন, দুর্যোগ পরবর্তী উদ্ধারকাজ খুবই ব্যয়বহুল। এরপর আমাদের পর্যাপ্ত সরঞ্জাম নেই। ৮০ হাজার ভোলান্টিয়ার তৈরি করার কথা থাকলেও আমার জানা মতে ২৫-৩০ হাজার তৈরি করা হয়েছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরিন বলেন, দুর্যোগ পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, আমরা শুধু বলেই যাচ্ছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আমরা কী হাইতির মতো ৮.৮ মাত্রা ভূমিকম্প এবং ৩ লাখ লোক মারা যাওয়ার পর সচেতন হবো নাকি আগে থেকেই প্রস্তুতি নিবো? সেটি এখন নির্ধারণ করতে হবে। তার মতে, বাংলাদেশ মোটেও খুব ভালো অবস্থানে নেই। যেকোন সময় বড় ধরনের দুর্যোগ নেমে আসতে পারে। তাই প্রস্তুতি এখনই নিতে হবে।
৭.৫ মাত্রার কম্পনে ভেঙে পড়বে ঢাকার ২৫ ভাগ ভবন
Share!