ব্যাংকিং খাতসহ সকল সেক্টরে লুটপাট করে ধ্বংসের পর এবার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। দুর্নীতির ব্যাপ্তি বাড়ানোর জন্য এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে বিশিষ্ট জনেরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাদের মতে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ালে সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে। জনগণ সাফার করবে। কৃষি ও শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হবে। সম্প্রতি পিডিবিসহ অন্যসব বিতরণ কোম্পানি কমিশনে বিদ্যুতের পাইকারি ও খুচরা মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বিদ্যুতের পাইকারি দাম ২৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ বাড়ানোর আবেদন করেছে। অন্যদিকে ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডেসকো) খুচরা বিদ্যুতের দাম ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ; ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ৮ দশমিক ৮৬; পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ওজোপাডিকো) ১০ দশমিক ৭৬ এবং পল্লীবিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। অন্যদিকে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো কমিশনের কাছে সর্বোচ্চ ১৪০ ভাগ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বলে সূত্র জানায়। প্রস্তাবে আবাসিকে ডাবল বার্নার গ্যাসের মূল্য ৭৭ শতাংশ, সিঙ্গেল বার্নারের ৮৩ শতাংশ বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে। মিটার ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে গ্যাসের মূল্য ১৪০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। শিল্পকারখানার ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ (নিজস্ব) উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১৩০ শতাংশ, বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৬৩ শতাংশ, কারখানার বয়লারের জন্য ৮২ শতাংশ, বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য ৭২ শতাংশ এবং সার কারখানার জন্য ৭১ শতাংশ বাড়ানোর আবেদন করেছে। একই সঙ্গে সিএনজির দাম ৬৬ শতাংশ বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত দাম আগামী পহেলা জুলাই থেকে কার্যকর করার আবেদন করেছে গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। : ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা বলেছেন, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ালে উৎপাদন খাত ও ব্যবসায় বিরূপ প্রভাব পড়বে। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা থাকায় গ্যাস-বিদ্যুতের বর্তমান মূল্যই সব ব্যবসায়ী দিতে পারছেন না। অনেকেই বিলখেলাপি হচ্ছেন। এখন আবার দাম বাড়ালে খেলাপি গ্রাহক আরো বাড়বে। শিল্পকারখানা বন্ধ হবে। প্রসঙ্গত গত ৫ বছরে ৬ বার বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। সর্বশেষ ৮ মাস আগে গত আগস্টে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এতে গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় দাম আড়াই টাকা থেকে প্রায় ৬ টাকা হয়েছে। গ্যাসের দামও সর্বশেষ গত বছরের আগস্টে গড়ে ২৬ শতাংশ বেড়েছে। আগে একচুলায় মাসিক গ্যাস খরচ ছিল ৪০০ টাকা, ডাবল বার্নারে ৪৫০ টাকা। যা বর্তমানে ৬০০ ও ৬৫০ টাকা করা হয়েছে। বর্তমানে প্রস্তাব দেয়া হয় তার দ্বিগুণ করার অর্থাৎ ১২০০ টাকার। আর সর্বশেষ গত ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে ডিজেলের দাম কমানো হয়। গত ৩১ মার্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত ফার্নেস তেলের দাম লিটারে ১৮ টাকা কমিয়ে ৪২ টাকা করা হয়। অন্যদিকে সর্বশেষ ২০১৩ সালে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সেই হারে বর্তমানে প্রতি লিটার অকটেন ৯৯ টাকা, পেট্রোল ৯৬ টাকা, কেরোসিন ও ডিজেল ৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। : বিশ্ববাজারে তেলের দাম হ্রাসের সুফল নেইÑরিজভী : বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির খবরে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, বিশ্ববাজারে যখন তেলের দাম কমছে, তখন তার কোনো সুফলই বাংলাদেশে মিলছে না। বরং এই তেল দিয়ে যে বিদ্যুৎ হয়, তার দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা চলছে। সরকার তার গণবিরোধী ভূমিকায় অনড় রয়েছে। দুর্নীতির ব্যাপ্তি বাড়ানোর জন্য সরকার বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করছে। তেল-গ্যাস সেক্টরে দুর্নীতি রোধ ও দক্ষতা বাড়িয়ে জনগণকে স্বস্তি দেয়ার জন্য তিনি দাবি জানান। : দাম বাড়লে সারপ্রাইজড হতোÑসালাম মুর্শেদী : এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেছেন, বর্তমান অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হলে সারপ্রাইজড হবে। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে শিল্পে গ্যাসের মূল্য ১০০ শতাংশ বেড়েছে। এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব মুর্শেদী মিডিয়াকে আরো বলেন, সব মিলিয়ে পোশাক শিল্পের ওপর দিয়ে অনেক ঝড় গেছে। আমরা এখন বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এ অবস্থায় আবার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে এ শিল্প হুমকির সম্মুখীন হবে। : বিদ্যুতের দর ৩/৪ গুণ বাড়িয়ে লুণ্ঠন চলছেÑবিডি রহমত উল্লাহ : বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক ও বিশেষজ্ঞ বিডি রহমত উল্লাহ সম্প্রতি মিডিয়ায় বলেছেন যে, বিদ্যুতের দর বা ট্যারিফ বাড়াতে সরকার আবার টালবাহানা শুরু করেছে বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। সরকার যদি তা বাস্তবায়ন করে তবে তা হবে সম্পূর্ণ অবৈধ ও অনৈতিক। সব ধরনের প্রাপ্ত উপাত্ত বিদ্যুতের দর কমানোর জোরালো হওয়া সত্ত্বেও উল্টো বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ কেন? সরকার কি কারণে এটা ভাবতে পারে। তিনি বলেন, আমাদের দেশের লুটেরা গোষ্ঠীর সিন্ডিকেট সদস্যরা অনৈতিক ও অবৈধ ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে জোর করে সবকিছু জনগণের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। তারা এসব সহজ-সরল হিসাব আড়াল রেখে দর নির্ধারণের বিষয়টি জটিল থেকে আরো জটিলতর করে প্রচার করে বেড়াচ্ছে। এরা নিরীহ জনতাকে মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করে বিদ্যুতের দর তিন-চার গুণ বাড়িয়ে দীর্ঘদিন অনৈতিকভাবে লুণ্ঠন করে আসছে। বিদ্যুতের দর নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সম্ভবত দুর্নীতির শীর্ষ স্থানীয় উদাহরণ। সম্প্রতি একটি নিবন্ধে হিসাব-নিকাশ করে বিশেষজ্ঞ বিবি রহমত উল্লাহ বলেন, প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মোট দাম সর্বাধিক পড়তে পারে ৩ টাকা ইউনিট। এর বেশি কিছুতেই নয়। রেন্টাল বিদ্যুতের মালিকদের স্বার্থ বজায় রাখতে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। : বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির যুক্তি নেইÑঅধ্যাপক ইজাজ : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেছেন, কম খরচের গ্যাসভিত্তিক কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চলছে। ফার্নেস অয়েলের দামও কমে গেছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এখন যেসব কেন্দ্রের উৎপাদন খরচ কম সেগুলো বেশি চালালে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কম হবে। তাই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তিই নেই। : গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ভিত্তি নেইÑঅধ্যাপক শামসুল : কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, সর্বশেষ এনার্জি রেগুলেটরির শুনানির সময় দেখা গেছে, যেসব বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিতরণ প্রতিষ্ঠান দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে তার কোনো ভিত্তি নেই। তখন ক্যাব দাম কমানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু কমিশন তা আমলে নেয়নি। আর বর্তমান অবস্থায় তো কোনোভাবেই দাম বাড়ানোর যুক্তি নেই। : বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির যুক্তি নেইÑম. তামিম : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ম. তামিম গতকাল বৃহস্পতিবার বলেছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমছেই। এ অবস্থায় বাংলাদেশে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির যুক্তি নেই। বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম আরো বলেন, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধির ওপরও তিনি গুরুত্ব দেন। : একদিন হয়ত সুবিধা পাবে ক্রেতারাÑকবির ভূঁইয়া : ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইইবি)-এর সভাপতি প্রকৌশলী কবির আহমদ ভূঁইয়ার সঙ্গে এ বিষয়ে গতকাল শুক্রবার যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমদানিকৃত তেলের দাম এখন কমেছে, কিন্তু আগের লসের জের তো আছে। পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে আগে লস দিতে হয়েছে। এখন তা কমবে। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ ব্যবহারে ক্রেতা কেন সুবিধা পাবে না? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তা একদিন হয়তো পাওয়া যাবে। এর পেছনে যুক্তি আছে। আইইবি এ বিষয়ে কোনো সেমিনার করতে পারে কি-না এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, জ্বালানি সেক্টরের বিষয় নিয়ে তো সেমিনার হতেই পারে। : সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়বেÑআনু মুহাম্মদ : তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এ সম্পর্কে বলেছেন, জ্বালানি তেলের মূল্য যখন সারা বিশ্বে কমছে, তখন দেশে এই তেলভিত্তিক বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির যুক্তি নেই। আর এই বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন পণ্যের দামও বাড়বে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিরোধিতা করে তিনি বলেন, পণ্য বৃদ্ধির কারণে সমাজে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। কৃষক-ব্যবসায়ীরা সবাই এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। : মূল্য বৃদ্ধির যুক্তি নেইÑপ্রকৌশলী গালিব : আবারও বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে প্রকৌশলী এস এম গালিব বলেন, সারা পৃথিবীতে জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপকহারে কমেছে। এর সুফল পাচ্ছে দেশগুলো। কিন্তু বাংলাদেশে অবস্থা ভিন্ন। উৎপাদন খরচ কমলেও সরকার দাম বৃদ্ধি করছে। যার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তিনি বলেন, দুর্নীতি আর লুটপাটের মাধ্যমে জ্বালানি খাতে রমরমা ব্যবসা চলছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রতিটি চুক্তির ভেতর ভয়াবহ দুর্নীতি আছে। এজন্য এসব চুক্তি প্রকাশ করা হয় না। সার্ভিস চার্জের নামে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে এখান থেকে।
Share!