যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় ১০ কোটি ডলার বা প্রায় ৮শ’ কোটি টাকা হ্যাকড হওয়ার ঘটনায় নজরদারিতে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের ব্যাক অফিসের (সিলিং) আট কর্মকর্তা।
এদের মধ্যে কয়েকজনের পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে। মূলত তারা যাতে দেশ ছাড়তে না পারেন সেজন্যই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে মুখ খুলছে না বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা।
সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক হ্যাকিংয়ের ঘটনা অস্বীকার করার পর সোমবার একাধিক বৈঠক করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা মনে করছেন, সুইফট কোড নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় জালিয়াতির মাধ্যমে এ ঘটনা ঘটতে পারে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট কোড পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকজন কর্মকর্তাকে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে। পাশাপাশি তাদের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। হ্যাক হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশে সিএমএ’র স্থানীয় প্রতিনিধির সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এর আগে ২০১৪ সালের ১১ নভেম্বর আন্তব্যাংক লেনদেন প্রযুক্তি ‘রিয়েল টাইম গ্রস সেটলমেন্ট’ (আরটিজিএস) বাস্তবায়নে সুইডেনভিত্তিক কোম্পানি সিএমএ স্মল সিস্টেম এবির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে সিএমএ’র স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনকারী সুইফটের সঙ্গে যুক্ত স্পেকট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম লিমিটেড।
বাংলাদেশ ব্যাংক হাতিয়ে নেওয়া অর্থ উদ্ধারে বিভিন্ন পর্যায় থেকে কাজ চলছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো পর্যায়ে গাফিলতি ছিল কিনা, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সম্প্রতি এ কাজের জন্য পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে বিশেষজ্ঞ দল জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কোড ব্যবহার করেই ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব
নিউইয়র্কে অর্থ স্থানান্তরের ৩০টি পরামর্শ (অ্যাডভাইস) পাঠানো হয়েছিলো। এর মধ্যে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পাঁচটি পরামর্শ কার্যকর হওয়ায় ১শ’ মিলিয়ন ডলার স্থানান্তরিত হয়ে যায় ফিলিপাইনে।
ধারণা করা হচ্ছে, ওই ২৫টি পরামর্শ কার্যকর হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে রাখা রিজার্ভের আরও বড় অংশ চুরি হয়ে যেত।
চীনা হ্যাকার গ্রুপ বিশেষ উপায়ে ফেডারেল রিজার্ভে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের পুরো সিস্টেম হ্যাক করে একের পর এক পেমেন্ট অর্ডার দেয়। এসব পেমেন্ট অর্ডারের অনেকগুলো দেওয়া হয় বিভিন্ন ব্যক্তি ও ব্যাংক শাখার অ্যাকাউন্টে। প্রথম চারটি অর্ডারের বিপরীতে ফেডারেল রিজার্ভ থেকে ফিলিপাইন ও শ্রীলংকায় ১০ কোটি ডলার পরিশোধ হয়ে যায়। এর মধ্যে শ্রীলংকায় যাওয়া আড়াই কোটি ডলার সমপরিমাণ প্রায় ২শ’ কোটি টাকা ফেরত পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাকি সাড়ে সাত কোটি ডলারের সমপরিমাণ ৬শ’ কোটি টাকা ফেরত আনার চেষ্টা চলছে, জানায় বিশেষজ্ঞ দল।
এদিকে সোমবার (০৭ মার্চ) এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ হ্যাকড হয়েছে- জানালে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কের মুখপাত্র আন্দ্রেয়া প্রিস্ট জানান, তাদের সিস্টেমে কোনো ধরনের হ্যাক হয়নি। ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমে কেউ অবৈধভাবে প্রবেশ করে অর্থ লেনদেন করার কোনো তথ্য নেই। ফেডারেল সিস্টেমে দুর্নীতিরও কোনো প্রমাণ নেই।
মঙ্গলবার (০৮ মার্চ) হ্যাকারদের বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো দোষ নেই উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সচিবালয়ে বলেন, এটা ফেডারেল রিজার্ভের দোষ। যারা এটা সেখানে পরিচালনা করেন তাদের কোনো গোলমাল হয়েছে। অথচ ফেডারেল রিজার্ভ বলছে যে তাদের কোনো দায়িত্ব নেই, এটা হতেই পারে না। তাদের কাছে টাকা রেখেছি। তারাই এ জন্য রেসপনসেবল। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে মামলা করবো।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র জানায়, জানা গেছে অর্থগুলো কোথায়, তাই অর্থ ফেরত আনা যাবে। তবে তা কিছুটা সময়সাপেক্ষ ও আইনি প্রক্রিয়ার বিষয়।
মঙ্গলবার (০৮ মার্চ) আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ নিয়ে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ১০ কোটি ডলার (প্রায় ৮’ কোটি টাকা) হাতিয়ে নেওয়া হয়।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক টাকা স্থানান্তর করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের ব্যাক অফিস (সিলিং) অনুমোদন নেয়।
ব্যক্তিগত হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ স্থানান্তরের বিষয়টি সন্দেহজনক হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবহিত করে মেইল পাঠায় ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃপক্ষ। তবে ফেডারেল রিজার্ভের অর্থ স্থানান্তরের সুইফট পদ্ধতিটি স্বয়ংক্রিয় হওয়ায় অর্ডার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা পরিশোধ হয়ে যায়।
এ ঘটনার এক মাস পেরিয়ে গেলেও এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি বলে জানা গেছে।