৩৬ দিনে গড়িয়েছে ফিলিস্তিন ইসরায়েল যুদ্ধ। এরমধ্যে নিজের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন ইসরায়েলের ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সামরিক পদক্ষেপ ছাড়া কোনো বিকল্প উপায় নিয়ে কোনো আলোচনা করবে না বলে সাফ জানিয়েছিল তেলআবিব। তবে এখন নমনীয় হচ্ছে ইসরায়েল। হামাসের সঙ্গে জিম্মিদের মুক্তির জন্য আলোচনা করছে তারা। খবর আলজাজিরার।
হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, গাজার উত্তরাঞ্চলে চার ঘণ্টার যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে ইসরায়েল। মূলত এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ এবং মানবিক সহায়তার অংম হিসেবে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতি কোনোভাবে বিশেষ কিছু না।
তারা বলছেন, গাজার বিভিন্ন হাসপাতালে হামলা করছে ইসরায়েল। এমনকি আস-শিফা হাসপাতালের আশপাশে বোমাবর্ষণ করে যাচ্ছে ইসরায়েলিরা। এতে করে সেখানে আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন রোগী ও চিকিৎসকরা। এ ছাড়া আরও চারটি হাসপাতাল ঘিরে রেখেছে তারা।
ইসরায়েলের হামলায় ফিলিস্তিনের ১১ হাজার লোক নিহত হয়েছেন। এ সময়ে আহত হয়েছেন আরও ২৭ হাজার বাসিন্দা। এমনকি এ সময়ে গাজার আস-শিফা হাসপাতাল চিকিৎসার জন্য জীবনরক্ষাকারী জরুরি পণ্যের মাত্র দুটি চালান পেয়েছে। এ অঞ্চলে যুদ্ধবিরতিকে মুলা ঝুলানো বলেন মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা বর্তমানে গাজায় পান করার জন্য পর্যাপ্ত পানিও নেই। হাসপাতাল ও অন্যান্য জরুরি সেবাগুলো জ্বালানি সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। অঞ্চলটিতে কেবল মানবিক সংকট বেড়েই যাচ্ছে।
গাজার এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতি গাজায় কিছুটা আশার সঞ্চার করছে। এতে করে গাজার বন্ধ হয়ে যাওয়া হাসপাতালগুলো পুনরায় চালু হতে পারে এবং জরুরি পণ্যসেবা তাদের চালান নির্বিঘ্নে সরবরাহ করতে পারবে। তবে গত ২৪ ঘণ্টার হামলার কারণে ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন অনেক বিশেষজ্ঞ তুলছেন। তারা বলছেন, এ বিরতি পর্যাপ্ত নয়।
একতরফা পদক্ষেপ
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈতিকতা, আইন এবং সশস্ত্র সংঘর্ষ বিভাগের সিনয়র ফেলো ইমানুয়েলা ও সহকারী ফেলো চ্যাথাম হাউজের চিয়ারা গিলার্ড গাজায় মানবিক বিরতির বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে তিনি বলেন, এর মাধ্যে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে।
অক্সফোর্ডের এ ফেলো বলেন, সংঘর্ষ এড়াতে যে কোনো সাময়িক পদক্ষেপ পরিস্থিতির আলোকে ইতিবাচক এবং এটা জরুরি। অবিলম্বে স্বল্প সময়ের জন্য যুদ্ধবিরতি ও যাবতীয় পদক্ষেপ বাতিল করার একটি অস্থায়ী কার্যাদেশ প্রয়োজন। যেখানে মানবিক কার্যক্রমের জন্য নিরাপদ ট্রানজিট ও জনগণকে মানবিক সহায়তার কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হবে।
এ অনুমতি ও মানবিক বিরতির বিষয়টি এখন পর্যন্ত একতরফা অবস্থায় রয়েছে। কেননা ইসরায়েল বা হামাস কোনোপক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেয়নি। ফলে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে যে দুই পক্ষই এ বিষয়টির প্রতি সম্মান দেখাবে কিনা। এজন্য তৃতীয় কোনো পক্ষের সম্মত হওয়ার বিষয়ে মধ্যস্থতা করা উচিত, যার প্রতি উভয় পক্ষই সম্মান দেখাবে।
বিরতি কোনো সমাধান নয়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানবিক বিরতি এখন জন্য যেটা প্রয়োজন তেমনকিছু নয়। গাজায় ইসরায়েলকে পরিপূর্ণভাবে আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে।
রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালযয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও মধ্যপ্রাচ্য গবেষণার অধ্যাপক আবদেল হামিদ সিয়াম বলেন, বিরতি কোনো সমাধান নয়। এর পরিবর্তে যেটা প্রয়োজন তা হলো যুদ্ধবিরতি। যাতে করে নিরবচ্ছিন্নভাবে মানবিক সাহায্য আসতে পারে, বিদেশিরা দেশ ছেড়ে যেতে পারে এবং আলোচনা হতে পারে।
তিনি বলেন, ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের কারণে এটা প্রমাণিত হয়েছে, তারা বেসামরিক লোকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
সিয়াম বলেন, এটি যদি শুধু উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য একটি বিরতি হয়, এটি অতীতে কাজ করেনি, এটি ভবিষ্যতে কাজ করবে না। কেননা চার ঘণ্টার বিরতিতে মানুষ আসতে পারবে না। তাদের কাছে গাড়ি নেই, জ্বালানিও নেই। ফলে এটি কোনো কাজে আসবে না।
তিনি বলেন, ইসরায়েলের ওপর ক্রমাগত চার বাড়ছে। তাদের ওপর এক, দুই, বা তিন দিনের মথ্যে যুদ্ধবিরতির জন্য তারা চাপে রয়েছে। ফলে কয়েক দিনের মধ্যে এমন ঘোষণা আসতে পারে।
আলোচনায় জিম্মিদের মুক্তি
দীর্ঘ এক মাসের চলমান যুদ্ধে অবশেষে জিম্মিদের মুক্ত করতে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের দ্বারস্থ হচ্ছে ইসরায়েল। যদিও শুরু থেকেই সামরিক পদক্ষেপ ছাড়া কোনো বিকল্প উপায় নিয়ে কোনো আলোচনা করবে না বলে সাফ জানিয়েছিল তেলআবিব। বলা হচ্ছে হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের অর্ধেকের কিছু কমসংখ্যক ব্যক্তি বেসামরিক নাগরিক। মূলত তাদের মুক্ত করতেই ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনা করছে নেতানিয়াহু প্রশাসন।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে দুটি প্রস্তাবকে সামনে রেখে হামাসের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এর একটি প্রস্তাবের আওতায় অল্পসংখ্যক বেসামরিক নাগরিককে মুক্তি দেওয়া হবে। অন্য একটি প্রস্তাবের আওতায় ১০০ বা তার বেশিসংখ্যক বেসামরিক বন্দিকে মুক্তি দেবে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা। এই আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে এসব তথ্য জানায় নিউইয়র্ক টাইমস।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ১০-২০ জন বন্দিকে মুক্তি দিতে পারে প্রতিরোধ যোদ্ধারা। এদের মধ্যে ইসরায়েলি নারী, শিশুসহ বিদেশি বন্দিরা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হলে এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবে হামাসসহ অন্যান্য প্রতিরোধ যোদ্ধারা। পরে স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হলে বাকি বেসামরিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জানান, বেসামরিক বন্দিদের মুক্তির বিনিময়ে হামাস স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ছাড়াও গাজায় আরও বেশি ত্রাণ সহায়তা, হাসপাতালগুলোর জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি এবং ইসরায়েলি কারাগারে আটক ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুদের মুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে। যদিও ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তির বিষয়ে কোনো প্রকার নিশ্চয়তা দিতে পারেনি ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীতে যোগদানে সক্ষম কোনো পুরুষকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে হামাস।
জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্র কাতারের মধ্যস্থতায় হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে এ আলোচনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জড়িত আছেন বলে জানায় মার্কিন সংবাদমাধ্যমটি।