ফেনীর পরশুরাম পৌরসভা নির্বাচনে ভোটের প্রয়োজন হয়নি। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে মেয়র ও ১২টি কাউন্সিলর পদের প্রতিটিতেই একক প্রার্থী ছিলেন। ফলে তাঁরা সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এবার পরশুরামের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনেও একই ঘটনা ঘটতে চলেছে। তিনটি ইউপিতেই চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী থাকায় তাঁরাও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে চলেছেন।
দুই মাস আগে পরশুরাম, দাগনভূঞা ও ফেনী পৌরসভা নির্বাচনে তিন মেয়র এবং ৪৮ সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলরের মধ্যে দুজন মেয়র ও ৪৩ জন কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
পরশুরামের তিন ইউপির বিএনপির চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন হুমকি, ভয়ভীতি ও এলাকাছাড়া হওয়ার কারণে তাঁরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। তবে প্রার্থীরা যাতে নির্ভয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেন, সে জন্য কেবল পরশুরামে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় এক দিন বাড়িয়েছিল নির্বাচন কমিশন। দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে সারা দেশে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ছিল গত বুধবার। কিন্তু পরশুরামের জন্য সময় বাড়িয়ে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত করা হয়। এ ছাড়া প্রার্থীদের অব্যাহত হুমকি এবং রিটার্নিং কর্মকর্তাকে মারধরের অভিযোগ ওঠায় ফুলগাজীর ছয় ইউপির নির্বাচন বুধবার স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন।
তবে বিএনপির প্রার্থীদের অভিযোগের বিষয়ে ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রহমান গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে ভরাডুবির আশঙ্কায় অনেকে প্রার্থী হননি। এখন ঢালাও অভিযোগ করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন বিএনপির নেতারা।
সময় বাড়ানোর পরও কেন মনোনয়নপত্র জমা দেননি, তা জানতে চাইলে পরশুরামের বক্সমাহমুদ ইউপি নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী ইব্রাহিম খলিল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে শেষ মুহূর্তে তিনি নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নেন। টানা দুই মেয়াদে এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা ইব্রাহিম খলিল বলেন, তাঁর মা তাঁকে বলেছেন, ‘ও হুত আগে জান বাঁচা। নিজে বাঁচি ন থাইকলে কিয়ের ইলেকশন।’ তিনি বলেন, চাপের কারণে এক সপ্তাহ বাড়িতে থাকতে পারেননি। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন পার হওয়ায় গতকাল শুক্রবার বাড়ি ফিরেছেন। তিনি বলেন, ‘এমন নির্বাচন আমি দেখিনি। পৌর নির্বাচন থেকে এভাবে চলছে।’
পরশুরামের মির্জানগর এবং চিথলিয়া ইউনিয়নেও বিএনপি মনোনীত দুই চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেননি। গতকাল তাঁরাও বাড়ি ফিরেছেন। একক প্রার্থী থাকায় পরশুরামের তিনটি ইউনিয়ন পরিষদের তিনজন চেয়ারম্যানের পাশাপাশি ১৫ জন সাধারণ সদস্য এবং আটজন নারী সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে চলেছেন। এর বাইরে তিন ইউনিয়নের ১২টি ওয়ার্ডের সাধারণ সদস্য এবং একটি সংরক্ষিত নারী সদস্যপদে একাধিক প্রার্থী রয়েছেন।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার এই কৌশলকে ‘ফেনী কালচার’ নামে অভিহিত করছেন বিএনপি স্থানীয় নেতারা। পরশুরাম উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু তালেব অভিযোগ করেন, পৌর নির্বাচন ও ইউপি নির্বাচনে দলের প্রার্থীদের সরিয়ে দিতে হুমকি দেওয়া হয়েছে। দলের অনেক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। অনেকে এলাকাছাড়া হওয়ায় মনোনয়ন জমা দিতে পারেননি। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন চলে যাওয়ায় এলাকাছাড়া হওয়া প্রার্থীরা এখন বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন।
পরশুরামের চিথলিয়া ইউনিয়নে বিএনপির মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী আবদুর রব মজুমদার নয় দিন পর বৃহস্পতিবার রাতে বাড়িতে ফিরেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করার পর ২৫ ফেব্রুয়ারি আমার বাড়িতে গিয়ে আমার শ্যালককে মারধর করা হয়। এরপর আমি আত্মগোপনে চলে যাই। যেহেতু নির্বাচন করছি না, তাই ফিরলাম। তবে এখনো ভয় লাগে।’
মির্জানগর ইউনিয়নে বিএনপির মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী ও উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক জামাল উদ্দিন চৌধুরীও এক সপ্তাহ পর বাড়িতে ফিরেছেন বৃহস্পতিবার। তিনি বলেন, ‘পৌর নির্বাচনের মতো এবারও আমাকে এবং আমাদের প্রার্থীদের ফরম জমা দিতে দেয়নি। এখন বাড়ি ফিরলাম। এমন নির্বাচন আমি আগে দেখিনি।’
মনোনয়নপত্র জমা না দিয়েও বৃহস্পতিবার মারধরের শিকার হন বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সদস্য পদপ্রার্থী নুরুল ইসলাম চৌধুরী। তাঁর অভিযোগ, মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেলে তাঁকে একই ওয়ার্ডের সদস্য পদপ্রার্থী ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল্লাহ মামুন হুমকি দেন। এ ঘটনায় মামুনকে কিছুক্ষণের জন্য আটক করে পুলিশ।
নুরুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ আমাকে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে আমি মামুনকে ছাড়িয়ে আনি। তখন মামুন আমাকে হুমকি দিচ্ছিল দেখে নেবে। থানা থেকে বের হয়ে ফেনী তমিজিয়া মসজিদের পাশে পৌঁছার পর কয়েকজন যুবক আমাকে মারধর করে। তবে তখন মামুন ছিল না।
ফেনীর পরশুরামে নির্বাচন মানেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা!
Share!