Monday , 23 December 2024
সংবাদ শিরোনাম

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের যে কজন বিদেশি শত্রু ছিল, বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বাকি দু’জন চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দে ও ভিয়েতনামের রাষ্ট্রনায়ক থিউ। এই তিনজনই বারবার তাঁর পরিকল্পনাকে বানচাল করে দিয়েছিলেন।

শেখ মুজিবের ওপর মি. কিসিঞ্জারের রাগটা বরং একটু বেশি। কেননা শেখ মুজিব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু করে চীন-মার্কিন সুসম্পর্কের সম্ভাবনাটায় প্রায় ভরাডুবি ঘটাতে বসেছিলেন। কারণ চীনের সঙ্গে দূতিয়ালী’র ভূমিকাটি নিয়েছিল পাকিস্তান। সেই পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তাঁর দূতিয়ালী’র কাছে যে কিছুটা ভাঁটা পড়বে, তা সহজেই বোঝা যায়।

মার্কিন সাংবাদিক ক্রিস্টোফার এরিক হিচিন্স ২০০১ সালে তাঁর ‘ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’ বইয়ে মুজিব হত্যায় কিসিঞ্জারকে দায়ী করেন। পুলিৎজার বিজয়ী মার্কিন সাংবাদিক সেইম্যুর হার্শ ১৯৮৩ সালে তাঁর ‘প্রাইস অব পাওয়ার’ বইয়ে এ বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের দিকে অভিযোগের তীর নিক্ষেপ করেন। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক লেখালেখিতেও মুজিব হত্যাকাণ্ড বিদেশি লেখক ও গবেষকদের মনোযোগের বিষয় হয়ে উঠেছে।

২০১০ সালে রবার্ট এস অ্যান্ডারসন তার ‘নিউক্লিয়াস অ্যান্ড নেশন’ বইয়ে দাবি করেন যে, বাংলাদেশ অভ্যুত্থান সম্পর্কে ইন্দিরা গান্ধী ‘অন্যান্য সূত্র’ থেকে খবর পেয়েছিলেন। ১৯৯৭ সালে জান্নিকি অ্যারেন্স ভারতের ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলিতে লেখেন, ‘সপরিবারে মুজিব হত্যা প্রায় নিশ্চিতভাবেই সিআই এর সহায়তায় ঘটেছে।‘ পিটার ডেল স্কট যিনি সাবেক কানাডীয় কূটনীতিক ও সাংবিধানিক আইনজীবী; ২০০৮ সালে তিনি তাঁর ‘রোড টু নাইন ইলেভেন’ বইয়ে লিফশুলৎজ ও হিচেন্স এর বরাতে উল্লেখ করেন, ১৯৭৪ সালে কিসিঞ্জারের ঢাকা সফরের পরে মার্কিন দূতাবারের একটি অংশ গোপনীয়তার সঙ্গে একদল বাংলাদেশি কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ড. পামেলা কে গিলবার্ট ২০০২ সালে তাঁর ‘ইমাজিনড লন্ডনস ‘বইয়ে লিখেছেনে, ‘সিআইএ মুজিব হত্যায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত থাকা প্রতিক্রিয়াশীল বাঙালিদের ব্যবহার করেছিল।’

মার্কিন দলিলপত্রই এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, ১৯৭২ থেকে ফারুক নিয়মিতভাবে মার্কিন মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। এমনকি ১৯৭৪ সালে তিনি মার্কিনীদের কাছে তাঁর অভ্যুত্থান পরিকল্পনা প্রকাশ করেন।

অভ্যুত্থানের আগের দুই বছরের বিভিন্ন সময়ে কিসিঞ্জার ও ভুট্রোর মধ্যকার আলোচনার গোপন নথির কথা জানা যায়। এত দেখা যায়, তাঁরা বাংলাদেশে একটি সম্ভাব্য সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে আলোচনা করেছেন।

১৯৮৯ সালে সানডে পত্রিকায় (২৩-২৯ এপ্রিল, ৮৯) ‘র’-এর প্রধান রমেশ্বর নাথ কাও লিখেছেন, ইন্দিরার অনুমোদনে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে আমি ঢাকা সফর করি। গণভবনের বাগানে আমি তাঁকে সতর্ক করি। এরপর পঁচাত্তরের মার্চে পুনরায় সতর্ক করতে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ঢাকায় পাঠাই। এসব সতর্কতা মুজিব অগ্রাহ্য করেছিলেন।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার সঙ্গে আমেরিকা কীভাবে, কতখানি যুক্ত-তা প্রকাশ করেছেন মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফসুল্টজ (Lawrence Lifschultz) তাঁর ‘বাংলাদেশঃ দ্যা আনফিনিশড রেভল্যুশন’ গ্রন্থে মিঃ লিফসুল্টজ নিউইয়র্কের ‘দি নেশন’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক কাই বার্ডের (Kai Bird) সঙ্গে বিষয়টি দীর্ঘ আড়াই বছরে প্রায় ২০০ লোকের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এই সব সাক্ষাৎকার গৃহীত হয় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও বাংলাদেশে। এ নিয়ে দীর্ঘ দিন সমীক্ষা চালিয়ে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, মুজিব হত্যায় আমেরিকারও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

ঐ গ্রন্থে মিঃ লিফসুল্টজ নিম্নলিখিত তথ্যগুলো পেশ করেছেন-

মার্কিন বিদেশ দপ্তরের অফিসার’রা তাঁদের বলেছেন যে, চক্রটি মুজিবকে হত্যা করে, তাদের প্রতিনিধিগণ ১৯৭৪ সালের শরৎকালে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে এসে এ ব্যাপারে সাহায্য চায়। (পৃষ্ঠা -১৭৭)

ঐ বিদেশ দপ্তরের সূত্র থেকেই জানা যায়, ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সিআইএ-এর ‘স্টেশন চিফ’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অর্থাৎ মুজিব হত্যার দিন পর্যন্ত চক্রান্তকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলো। ঐ সূত্র ই মিঃ লিফসুল্টজকে জানিয়েছে যে, মাহবুব আলম চাষী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, এ.বি.এস সফদার ছিলেন তখন মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-এর মুখ্য এজেন্ট। ঢাকার সিআইএ-এর স্টেশন চিফ (১৯৭৪-১৯৭৬) ফিলিপ চেরি বলেছেন, ‘আমাদের যোগাযোগটা এতো ভালো ছিল যে, অভ্যুাত্থানের খবর পেয়ে আমরা খুব শীগগিরই তা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে পেরেছিলাম।’ মিঃ ফিলিপ স্বীকার করেন যে, ‘তিনি যখন যুক্তরাষ্ট্রে খবর পাঠান, তখনও (ঢাকায়) অভ্যুত্থান চলছিল।’

ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের এক অফিসার জানান, ‘(প্রস্তাবিত অভ্যুত্থান সম্পর্কে) যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব কি, তা জানার জন্য যাঁরা ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে আসতেন, তাঁদের সঙ্গে ঘটনার চার-পাঁচ মাস আগে থেকেই বৈঠক হয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সিআইএ এর পোষকতায় পরিচালিত বিভিন্ন স্কুলে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা তিনি অনেক দিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দিয়েছিলেন।

ঢাকার সিআইএ – এর স্টেশন অফিসার ফিলিপ চেরি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ব্যাপারটা আমি খুব ভালোভাবেই জানতাম। কিন্তু……

মিঃ চেরি তাঁর কথা শেষ করেন নি। তা শেষ না করলেও বোঝা যায়, তিনি কি বলতে যেয়েও বলতে পারেন নি। সম্ভবত তিনি বলতে চেয়েছিলেন, যা ঘটেছে সে সম্পর্কে সব কিছুই তাঁর আগে থেকেই জানা ছিল। কিন্তু সরকারী গোপনীয়তা রক্ষার জন্য সে সব কথা বলা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

মিঃ লিফসুল্টজের ‘বাংলাদেশ, দ্যা আনফিনশড রেভল্যুশন’ বইয়ের পাতা থেকে আমাদের নজরটা ঢাকার দিকে ফেরানো যাক।

ঢাকায় দেখা যাচ্ছে, সেখানকার মার্কিন দূতাবাস তিন দিন আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ছুটির দিন বলে ঘোষণা করেছে। এ ছুটির তালিকা বহির্ভূত ছুটির তালিকা। ঐ দিনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।

ঢাকার মার্কিন দূতাবাস ঐ ১৫ আগস্ট হঠাৎ ছুটির দিন বলে ঘোষণা করেছিল কেন? কারণ তাঁদের কাছে আগাম খবর ছিল? ঐদিন সৈন্যবাহিনীর একদল চক্রান্তকারী অফিসার শেখ মুজিবকে হত্যা করবে? দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের গোপন এক বৈঠকে, মেজর ফারুকের উপর দায়িত্ব পড়ে সেই নীল নকশার ‘এ্যাকশন’ –এর দিকটা কার্যকর করতে।

এই হত্যার সঙ্গে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসেরও যে ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল, অন্যদিক থেকেও তার প্রমাণ মিলে। মুজিব হত্যার প্রথম ঘোষণা আসে ওয়াশিংটনে ‘ভয়েস অব আমেরিকা’ থেকে। সে ঘোষণা পৃথিবীময় ছড়িয়ে যায় এমন একটা সময়ে, যখন হত্যাকাণ্ড সম্পূর্ণ শেষ হয় নি। হত্যাকারীদের গাড়িগুলি তখনও ঢাকার রাজপথ কাঁপিয়ে এ-দিক সে-দিক ছুটোছুটি করছে।
ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সিআইএ এর স্টেশন অফিসার ফিলিপ চেরি নিজেই স্বীকার করেছেন, চক্রান্তকারীদের সঙ্গে বরাবরই তাঁর যোগাযোগ ছিল। মুজিব-হত্যার সংবাদ তিনিই ওয়াশিংটনে পাঠিয়েছিলেন। ‘ভয়েস অব আমেরিকা’র সেই সংবাদ বুলেটিনই প্রমাণ করে মুজিব-হত্যায় আমেরিকার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল।

মুজিব-হত্যার সেই বীভৎস কালরাতে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের অবস্থান কি ছিল? আগে থেকেই ১৫ আগস্ট দূতাবাসের ছুটির দিন বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। অথচ ১৪-১৫ আগস্ট (ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী)

সারারাত ঐ দূতাবাসে চলছিল অসীম কর্মব্যস্ততা। দূতাবাসের উচ্চপদস্থ অফিসারদের অধিকাংশই সেদিন অফিসে রাত কাটিয়েছেন। এ বিষয়ে বই থেকে কিছুটা উদ্ধতি দিইঃ

‘প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে জানতে পেরেছি, শেখ মুজিবকে যেদিন হত্যা করা হয়, সেদিন রাতে মার্কিন দূতাবাস খুবই কর্মচঞ্চল ছিল। উচ্চপদস্থ অনেক অফিসারই সেদিন ঘুমোতে যান নি। ঐ অভ্যুত্থানে নিহত শেখ সেলিম ও শেখ মারফক তাঁদের বাড়ির নিকটবর্তী মার্কিন দূতাবাসের প্রধান সচিবের বাড়িতে আশ্রয় নিতে যান। কিন্তু প্রধান সচিব তখন বাড়িতে ছিলেন না। সারারাতই তিনি দূতাবাসে কাটিয়েছেন। তাঁর পত্নী শেখ ভ্রাতৃদ্বয়কে বাড়িতে বসিয়ে স্বামীর কাছে টেলিফোন করেন। সব কথা জানান। প্রধান সচিব ওয়াশিংটন থেকে অনুমতি আনিয়ে মাত্র দিন কয়েকের জন্য তাঁদের নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিতে সম্মত হন। অবশ্য শেখ সেলিম ও তাঁর ভাই একদিনের বেশি সে বাড়িতে থাকেন নি।’

এই ঘটনা থেকে জানা যায়, মুজিব-হত্যার রাতে (১৯৭৫ সালের ১৪-১৫ আগস্ট) ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের প্রধান সচিব বাসায় ফিরেন নি। সারারাতই দূতাবাসে ছিলেন। কিন্তু কেন ছিলেন?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে, একটা সিদ্ধান্তই আমাদের মনে আসবে, ঐদিন ভোর রাতে (ইংরেজি ক্যালেন্ডার মতে ১৫ আগস্ট) শেখ মুজিব, তাঁর ভগ্নীপতি ও ভাগ্নে তাঁদের পরিবারসহ নিহত হচ্ছেন, এ খবর তাঁদের কাছে ছিল।

সুতরাং শুধু সবিশেষ সাক্ষ্যই (সারকামস্টেশিয়াল এভিডেন্স) নয়, আমাদের সংগৃহীত তথ্যাদিও প্রমাণ করে যে, মুজিব-হত্যার পেছনে যে আন্তর্জাতিক দুষ্টচক্র কাজ করে, তাদের পালের গোদা ছিল মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ। এর পরই পাকিস্তান ও পশ্চিম এশিয়ার দু’একটি মুসলিম রাষ্ট্র-বিশেষ করে সৌদি আরবের স্থান। এই আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীর দলই বাংলাদেশে তাদের ক্রীতদাসদের দিয়ে সে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক, সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটিয়েছে।

বাংলার মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রধান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top