রপ্তানির আড়ালে দেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধে বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ মর্মে মঙ্গলবার সার্কুলার জারি করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে বলা হয়েছে, গ্রাহকের পরিচয় গোপন করে বা বেনামে শেল ব্যাংকের মাধ্যমে কোনো পণ্য রপ্তানি করা যাবে না।
বিদেশে শেল ব্যাংকের সঙ্গে দেশের কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক সম্পর্কও রাখতে পারবে না। আন্তঃদেশীয় সীমান্ত ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে ঝুঁকি মোকাবিলায় সতর্ক থাকতে হবে। দেশি ব্যাংকগুলোর বিদেশি ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব (নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট) খোলা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে আরোপিত বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। অন্যথা হলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
সার্কুলারে আরও বলা হয়, রপ্তানি বাণিজ্যের লেনদেনকে ঝুঁকিমুক্ত করতে, যথাসময়ে রপ্তানির মূল্য দেশে ফিরিয়ে আনতে এবং রপ্তানির আড়ালে টাকা পাচার বন্ধ করতে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিষয়গুলো গ্রাহকদের নজরে আনার জন্যও ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সার্কুলারে।
শেল ব্যাংকিং হচ্ছে এক ধরনের বিশেষ ব্যাংকিং ব্যবস্থা। এতে ব্যাংক গ্রাহকের নাম-ঠিকানা ছাড়াই শুধু একটি কোড নম্বরের ভিত্তিতে হিসাব খুলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য করা যায়। নাম-ঠিকানা থাকে না বলে এতে গ্রাহকের পরিচয় জানা যায় না। ফলে আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে অর্থ পাচারের সুযোগ রয়েছে। অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী দেশে শেল ব্যাংকের কার্যক্রম নিষিদ্ধ। তবে কিছু দেশে এর কার্যক্রম রয়েছে।
যেসব দেশে লেনদেন নীতিমালা শিথিল, ওইসব দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে শেল ব্যাংক পরিচালনার অনুমতি রয়েছে। এমন কয়েকটি দেশের শেল ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক এলসির মাধ্যমে পণ্য রপ্তানি করেছে-যা বেআইনি। এ বিষয়টি তদন্ত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সার্কুলারে বলা হয়, আন্তঃদেশীয় সীমান্ত এলাকায় ব্যাংকগুলোকে প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত এলাকায় থাকা ব্যাংকগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। এক্ষেত্রে ঝুঁকি মোকাবিলার বিধিনিষেধগুলো মেনে চলতে হবে।
একই সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে। যাতে অর্থ পাচারের কোনো ঘটনা না ঘটে। বিদেশি ব্যাংকে নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট খোলা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান মেনে চলতে হবে। কোনো ব্যাংক এসব বিধি না মানলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যাংকে এলসি খোলার মাধ্যমে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে। প্রয়োজনে তৃতীয় কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে এলসির সত্যতা যাচাই করে নিতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় কোনো সন্দেহ হলে পণ্য রপ্তানি করা যাবে না।
এলসির বাইরে চুক্তিপত্রের মাধ্যমে রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে সার্কুলারে বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে চুক্তির সত্যতা, যে ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে তার সঠিকতা, গ্রাহকের অবস্থা ও সুনাম সম্পর্কে জেনে নিতে হবে। এ বিষয়ে প্রয়োজনে তৃতীয় কোনো ব্যাংকের সহায়তা নিতে হবে। চুক্তির কাগজপত্র যথাযথভাবে নিরীক্ষণ করে নিয়ে ব্যাংক এর সত্যতা ও ঝুঁকির সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই পদক্ষেপ নিতে হবে। এগুলো নিশ্চিত না হয়ে রপ্তানি করলে মূল্য দেশে না আসার ঝুঁকি রয়েছে। এক্ষেত্রে দায়দায়িত্ব প্রধানত ব্যাংকের ওপরই বর্তাবে।
রপ্তানির আড়ালে দেশ থেকে প্রতি বছর মোটা অঙ্কের অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর যে অর্থ পাচার হচ্ছে তার ১৯ শতাংশ হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে। দেশ থেকে গত অর্থবছর ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর ১৯ শতাংশ হিসাবে অন্তত ৭৬০ কোটি ডলার প্রতি বছর দেশ থেকে পাচার হচ্ছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে অপ্রত্যাবাসিত অর্থাৎ রপ্তানি আয় দেশে না আনার পরিমাণ বাড়ছে। এগুলো দেশে আনার ক্ষেত্রে তদারকি বাড়ানো হলেও তেমন একটা আসছে না। ধারণা করা হচ্ছে, ওইসব অর্থ বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। করোনার সময়ে অপ্রত্যাবাসিত রপ্তানি আয়ের পরিমাণ আরও বেড়েছে।