বরিশালে দলিল লেখক রেজাউল করিম রিয়াজ (৪৫) হত্যার দেড় বছর পর ৩ খুনী ধরা পড়েছে। চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার তৃতীয় তদন্ত কর্মকতা ওই ৩জনকে আদালতে হাজির করলে তারা জবানবন্দীতে রিয়াজকে খুনের কথা স্বীকার করেছে। কিন্তু এ হত্যা মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালী মডেল থানার উপ পরিদর্শক বশির আহমেদ নিহত রিয়াজের স্ত্রী আমিনা আক্তার লিজা(৩০) কে স্বামীর খুনী বানিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গৃহবধূ লিজা দাবী করেছেন, স্বামী হত্যার শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই তাকে পরিদর্শক বশির গ্রেপ্তার করে শারীরিক নিযার্তন এবং মা ও ভাই-বোনকে আটকে রেখে শিখিয়ে দেয়া স্বীকারোক্তী নেয়। এর নেপথ্যে ছিল স্বামীর সম্পত্তি আত্নসাত করা এমনটাই জানান বিমর্ষ লিজা। হত্যা মামলাটি বিস্ময়করভাবে মোড় নেয়ায় বিব্রত বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ (বিএমপি) নতুন করে একজন উচ্চপদস্ত কর্মকতার্কে ঘটনাটি তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছে।
স্বামীহারা গৃহবধূ লিজা অভিযোগ করেছেন, তাকে গ্রেপ্তারের পর সারারাত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেছেন কোতোয়ালী মডেল থানার পরিদর্শক বশির আহমেদ। এমনকি তার মা ও দুই ভাইবোনকে থানায় আটকে রেখে তাদেরকেও মামলায় ফাঁসানোর ভয়ভীতি দেখানো হয়। এমন পরিস্থিতিতে তিনি পুলিশের শিখিয়ে দেয়া স্বীকারোক্তী দিয়েছেন মাত্র। জানা গেছে, দলিল লেখক রিয়াজকে গতবছর ১৮ই এপ্রিল দিবাগত রাতে বরিশাল সদর উপজেলার চরমোনাই ইউনিয়নের বুখাইনগর গ্রামে বসতঘরে কুপিয়ে হত্যা করে অজ্ঞাত দৃবৃর্ত্তরা। নিহতের ভাই মনিরুল ইসলাম রিপন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। তখন নি:সন্তান এ দম্পতির ঘরে ওই রাতে অন্য কেউ ছিলনা। দলিল লেখা ছাড়াও জমি কেন-বেচা এবং সুদের ব্যবসা করায় রিয়াজ আর্থিকভাবে যথেষ্ট সচ্ছল ছিলেন। মামলা দায়েরের পর তদন্ত কর্মকর্তা বরিশাল কোতোয়ালী মডেল থানার উপ পরিদর্শক মো. বশির স্ত্রী লিজাকে গ্রেপ্তার করলে, তিনি ২০শে এপ্রিল মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট আনিসুজ্জামানের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেন। ওই সময়ে লিজার জবানবন্দী অনুযায়ী, রিয়াজের সহকর্মী মাসুমের সঙ্গে পরকিয়া প্রেম ছিল। ঘটনার দিন রাতে মাসুম তার এক সহযোগী নিয়ে লিজার সহযোগীতায় রিয়াজের ঘরে ঢুকে মাচায় পালিয়ে থাকে। রিয়াজ ঘুমিয়ে পড়লে রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে রিয়াজকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরে মামলাটি একই থানার উপ পরিদর্শক ফিরোজ আল মামুনও মামলাটির তদন্ত করে আগাতে পারেননি। তবে মামলার তৃতীয় তদন্ত কর্মকর্তা নগরীর কাউনিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. ছগীর হোসেন গত ১৪ই আগস্ট বাকেরগঞ্জ উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামে একটি চুরি মামলায় ওই এলাকার জলিল সিকদার (২৮) নামক এক যুবককে গ্রেপ্তার করেন। তার স্বীকারোক্তীনুযায়ী ২৭ জানুয়ারী ঢাকা থেকে রায়হান চৌকিদার (২০) এবং ২৮ জানুয়ারী শাকিল হাওলাদার (২০) নামক আরও দুই যুককে গ্রেপ্তার করেন পরিদর্শক ছগীর হোসেন। রায়হান ও শাকিল নিহত রিয়াজের প্রতিবেশী। এই তিনজন গত ২৮ আগষ্ট বরিশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট রিয়াজকে হত্যার কথা স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছে বলে জানান তদন্তকারী কর্মকর্তা ছগির। তাদের দাবী, তারা নেশাগ্রস্থ যুবক। নেশার টাকা সংগ্রহের জন্য প্রায়ই চুরি ছিনতাই করে। প্রতিবেশী স্বচ্ছল রিয়াজের ঘরে চুরির জন্য একাধিক হানা দিয়েছে। ঘটনার দিন রিয়াজ ঘুমিয়ে পড়লে পূর্ব পরিকল্পলনা মতো তারা দা দিয়ে সিদ কেটে ঘরে ঢুকলে রিয়াজ জেগে ওঠে। তাদের চিনে ফেলায় কিছু বোঝার আগেই হাতে থাকা দা দিয়ে জলিল রিয়াজের গলায় একাধিক কোপ এবং শাকিল ছুড়ি পেটে ঢুকিয়ে দেয়। তিন যুবকের দাবী, রিয়াজ বিছানায় একা ছিল তার স্ত্রী লিজা ছিল অন্য ঘরে।
তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক ছগীর বলেন, মামলাটি স্পর্শকাতর হওয়ায় উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তে অধিকতর তদন্তের জন্য এ বছরের ২৩ ফেব্রয়ারী তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি বিগত তদন্ত প্রতিবেদনগুলোর অনেক অসঙ্গতি দেখে ওই দূর্বল জায়গায়গুলোতে খোঁজ খবর নেয়া শুরু করেন। খুনীরা রিয়াজের ৪টি মোবাইল সেট নিয়েছিল। ২টি গ্রেপ্তার হওয়া তিন যুবকদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। মুলত ওই মোবাইল সেটের সুত্র ধরেই তিন যুবককে চিহিৃত করে তাদের পিছু লাগেন।
মামলার এমন পরিস্থিতিতে লিজার স্বীকারোক্তীর ভিত্তি কি জানতে চাইলে প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা উপ পরিদর্শক বশির আহমেদ বলেন, লিজার স্বীকারোক্তী আদালত গ্রহন করেছে। আদালতই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন। লিজাকে নির্যাতন ও অর্থ নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
এব্যপারে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান সাংবাদিকদের বলেন, যেহেতু মামলাটির তদন্তে দুই ধরনের স্বীকারোক্তি উঠে এসেছে । তাই সত্য উদঘাটনের জন্য একজন দক্ষ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তদন্তে পাওয়া এ পর্যন্ত সকল তথ্য উপাত্ত যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তদন্ত শেষ হলে কোন কর্মকর্তা তদন্তে গাফেলতি বা অনিয়ম করেছেন কি-না তা খতিয়ে দেখা হবে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পুলিশ যেভাবে স্ত্রী কে স্বামীর খুনি বানিয়েছিল
Share!