ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি মারা গেছেন। সোমবার নয়াদিল্লীর একটি সেনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪।
প্রণব মুখার্জির ছেলে অভিজিৎ মুখার্জি এক টুইট বার্তায় এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, ‘দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, সেনা হাসপাতালের চিকিৎসকদের প্রাণপণ প্রচেষ্টা, সারা ভারতের মানুষের প্রার্থনা, দুয়া সত্ত্বেও এইমাত্র আমার বাবা শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় মারা গিয়েছেন। আমি আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
গত ১০ আগস্ট নয়াদিল্লীর সেনা হাসপাতালে প্রণব মুখার্জিকে ভর্তি করা হয়েছিল। পরীক্ষার সময় দেখা গিয়েছিল, তাঁর মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। তাঁর করোনা রিপোর্টও পজিটিভ এসেছিল। অস্ত্রোপচারের পর থেকেই ভেন্টিলেশনে ছিলেন তিনি। কখনও কখনও শারীরিক অবস্থার উন্নতি খবর মিললেও কখনও কখনও প্রণব মুখার্জির শারীরিক অবস্থা আরও জটিল হয়েছে। মূত্রাশয় সংক্রান্ত সমস্যা এবং ফুসফুসে সংক্রমণও ধরা পড়েছিল তাঁর। কিন্তু যাবতীয় লড়াই শেষে হাসপাতালে ভরতির ২২ দিনের মাথায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রণব মুখার্জি।
২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ভারতের ১৩ তম রাষ্ট্রপতি ছিলেন প্রণব মুখার্জি। পরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে লড়তে চাননি তিনি। বরং রাজনীতি থেকে অবসর নেন৷
৫০ বছরেরও বেশি সময় সক্রিয় রাজনীতিতে থাকা প্রণব মুখার্জিকে ২০১৯ সালে ভারত রত্ন সম্মানে ভূষিত করা হয়৷ ১৯৯৭ সালে তিনি সেরা সাংসদ পুরস্কার পেয়েছিলেন৷ ২০০৮ সালে পদ্মবিভূষণ সম্মান পান তিনি৷
১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। প্রণব মুখার্জির কর্মজীবন শুরু শিক্ষকতা দিয়ে। কিছু দিন সাংবাদিকতাও করেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ও নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনেরও নেতৃত্ব দেন কিছু সময়।
তিনি প্রায় ৪৪ বছর যাবত ভারতের সংসদ সদস্য ছিলেন কংগ্রেসের এই রাজনীতিবিদ। ১৯৬৯ সালে প্রথম রাজ্য সভার সদস্য নির্বাচিত হন শেষে ১৯৯৯ সালেও তিনি জনগণের ভোটে রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি অত্যন্ত তরুণ বয়সে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সভার শিল্পোন্নয়ন উপমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন ১৯৭৩ সালে । এবং ১৯৮২ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সভার অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৮ সালের দিকে তিনি কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার হয়ে রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে আরেকটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর পর অবশ্য তার এই দল নিয়ে আবার কংগ্রেসের সাথে মিশে যান। এর পর একে একে প্রতিরক্ষা, অর্থ, বিদেশ, রাজস্ব, জাহাজ-চলাচল, পরিবহন, যোগাযোগ এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতো একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের বিরল কৃতিত্বের অধিকারী তিনি। তিনি আবার পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের সভাপতি।
২০১২ সালে প্রণব মুখার্জি ভারতে ১৩ তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশের সাথে প্রণব মুখার্জির নাড়ীর সম্পর্ক: বাংলাদেশে ১/১১ ও বিডিআর বিদ্রোহের সময় তিনি বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। যা তিনি তার আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। তার সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্বের সূচনা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে। তাঁর আত্মজীবনীমূলক সিরিজের প্রথমটি দ্য ড্রামাটিক ডিকেড: দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস–এ তিনি একটি পুরো অধ্যায়ই লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ: দ্য মেকিং অব বাংলাদেশ’ নামে।
ভারতের সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের মতে, বাংলাদেশের প্রতি প্রণব মুখার্জির দুর্বলতা অপরিসীম; অনেকটা জ্যোতি বসুর মতোই। জ্যোতি বসুর পৈতৃক বাড়ি ছিল বারদিতে, লোকনাথ বাবার আশ্রমের পাশেই। সেই অর্থে তিনি ছিলেন বাঙাল। প্রণববাবু আপাদমস্তক ঘটি তাঁদের আদি বাড়ি দীঘাতে। তবে বিবাহসূত্রে তিনিও বাংলাদেশের জামাই।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রণব মুখার্জির পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয় পঁচাত্তরের পর তিনি (শেখ হাসিনা) যখন দিল্লিতে নির্বাসিত ছিলেন।