Monday , 23 December 2024
সংবাদ শিরোনাম

ঝালকাঠিতে জমেছে নৌকার হাট

জ্যৈষ্ঠ থেকে শুরু করে আষাঢ় পেরিয়ে ভাদ্রের শেষ পর্যন্ত দূর-দূরান্তের বেপারিদের আনাগোনায় পেয়ারা মোকামগুলোতে রীতিমতো উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সেই সঙ্গে পেয়ারার স্বাদ নিতে বহু পর্যটকের এসব নদীপথে দেখা মেলে।

ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় গিয়ে পেয়ারা চাষী, ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা পাইকারের ট্রলার, মালবাহী নৌকায় তুলে দেন। কোথাও ঝুড়ি ভরে বাছাই করা পেয়ারা ট্রাকে তুলে দেয়া হচ্ছে। পেয়ারার মৌসুম ঘিরে নৌকায় করে ‘নাইওর’ আসে কন্যারা। যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় সারা বছরই নৌকায় চলাচল করলেও বর্ষা কালে এর কদর বাড়ে কয়েকগুণ।

‘ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল’-এর বাস্তব উপলব্দি করা যায় পেয়ারা এলাকাগুলোতে গেলে। বরিশাল বিভাগের অন্যত্র ছিটে ফোঁটা পেয়ারা হলেও বরিশালের বানারীপাড়া, ঝালকাঠি সদর ও পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি ঘিরেই মূলত পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ।

বরিশালের বানারীপাড়ার ১৬ গ্রামে ৯৩৭ হেক্টর, ঝালকাঠির ১৩ গ্রামে ৩৫০ হেক্টর জমিতে, স্বরূপকাঠির ২৬ গ্রামের ৬৪৫ হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়। এসব এলাকার মধ্যে ঝালকাঠির কীর্তিপাশা, ভিমরুলী, শতদশকাঠি, খাজুরিয়া, ডুমুরিয়া, কাপুড়াকাঠি, জগদীশপুর, মীরকাঠি, শাখা গাছির, হিমানন্দকাঠি, আদাকাঠি, রামপুর, শিমুলেশ্বর এই গ্রামে বৃহৎ অংশ জুড়ে বাণিজ্যিকভাবে যুগ যুগ ধরে পেয়ারার চাষ হয়। স্বরূপকাঠির ২৬ গ্রামের মধ্যে রয়েছে সঙ্গীতকাঠি, খায়েরকাঠি, ভদ্রানন্দ, বাচ্চুকাঠি, ভাংগুরা, আদাবাড়ী, রাজাপুর, ব্রাহ্মণকাঠি, ধলহার, জিন্দাকাঠি, আটঘর, কুড়িয়ানা, পূর্ব জলাবাড়ি, ইদিলকাঠি, আরামকাঠি, মাদ্রা, গণপতিকাঠি, আতাকাঠী, জামুয়া, জৈলশার, সোহাগদল, আদমকাঠী, অশ্বত্থকাঠী, সমীত, সেহাংগল, আন্দারকুল। বরিশালের বানারীপাড়ার পেয়ারা বাগানগুলো হলো তেতলা, সৈয়দকাঠী, মালিকান্দা, ব্রাহ্মণবাড়ি, বোয়ালিয়া, জম্বুদ্বীপ, বিশারকান্দি, মরিচবুনিয়া, মুরার বাড়ি, উমরের পাড়, লবণ সড়া, ইন্দির হাওলা, নরেরকাঠি, রাজ্জাকপুর, হলতা, চুয়ারিপাড়। এসব গ্রামের কয়েক হাজার কর্মজীবী পরিবার যুগ যুগ ধরে পেয়ারার চাষ করছে।

পেয়ারার চাষ, ব্যবসা ও বাজারজাতকরণেও রয়েছে কয়েক হাজার মৌসুমী বেপারী এবং শ্রমিক। এসময় অন্তত কুড়িটি স্থানে পেয়ারা পণ্যের মৌসুমী মোকামের সৃষ্টি হয়। এগুলো হলো ভিমরুলী, আতাকাঠি, ডুমুরিয়া, গণপতিকাঠি, শতদশকাঠি, রাজাপুর, মাদ্রা, আদমকাঠি, জিন্দাকাঠি, বর্ণপতিকাঠি, আটঘর, কুড়িয়ানা, আন্দাকুল, রায়ের হাট, ব্রাহ্মণকাঠি, ধলহার, বাউকাঠী। নৌকায় করে এসব মোকামের মৌসুমে প্রতিদিন ৫/৭ হাজার মন পেয়ারা কেনাবেচা হয়ে থাকে। বর্ষা মৌসুম। অঝোড়ে ঝড়ছে শ্রাবণ ধারা। সেই সাথে বাড়ছে নদী-খালের পানিও। সর্বত্রই পানি থৈ থৈ করছে। আর এ মৌসুম এলেই ঝালকাঠি সদর উপজেলার ৩ ইউনিয়নের বাসিন্দাদের জিবীকা অর্জনের অন্যতম বাহন নৌকা। তবে সে নৌকা বড় মালবাহী কোন নৌকা নয়, সেটি হচ্ছে ডিঙি নৌকা।

একদিকে নৌকা বানিয়ে বিক্রি। অপরদিকে যাতায়াত ও উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য ব্যবহার করা হয় নৌকা। ঝালকাঠি সদর উপজেলার কির্ত্তীপাশা, নবগ্রাম ও গাভারামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের চিত্র এটি। ঝালকাঠি, পিরোজপুরের স্বরুপকাঠি ও বরিশালের বানারিপাড়া এলাকার সীমান্তে ৫৫ গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছে পেয়ারা। এসব এলাকার মানুষের উপার্জনের প্রধান মাধ্যম পেয়ারা ও সাথী ফসল হিসেবে সবজি বাজারজাত করণের মাধ্যমে। বাজার জাতের প্রধান মাধ্যম হস্তচালিত ডিঙি নৌকা। বর্ষা মৌসুম আসায় ঝালকাঠি-স্বরূপকাঠির সীমান্ত আটঘর-কুড়িয়ানা এলাকা পরিণত হয়েছে যেন এক নৌ সাম্রাজ্যে। চলছে জমজমাট নৌকার ব্যবসা। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এ ব্যবসা এলাকার মানুষের কাছে একটি অন্যতম ঐতিহ্য। নয়নাভিরাম নৌকার পসরা চোখে না দেখলে মনেই হবে না জলে-ডাঙায় এক সঙ্গে এতো নৌকার সমারোহ ঘটতে পারে। পিরোজপুরের সুন্দরী কাঠ সমৃদ্ধ এলাকা স্বরূপকাঠি উপজেলা এবং ঝালকাঠি সদর উপজেলার ২০ গ্রামের দেড় হাজারের বেশি পরিবার কয়েক যুগ ধরে নৌকা-বৈঠা তৈরি ও বিক্রি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন।

জানা যায়, এ অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার প্রধান বাহনই হচ্ছে নৌকা। আর তাই নৌকা বেচা-কেনাকে কেন্দ্র করে সন্ধ্যা নদীর শাখা খালে যুগের পর যুগ বসছে নৌকার হাট। প্রতি শুক্র এবং রোববার বসে এ হাট। স্বরূপকাঠির আটঘর, আদমকাঠি, জিন্দাকাঠি, বাস্তকাঠি, বেঙ্গুলী, দলহার, আতাপাড়া, ইন্দুরকানী, কুড়িয়ানা, ঝালকাঠির ভিমরুলী, শেখেরহাট, শতদশকাঠি, ভিমরুলি, কাপুড়কাঠি, কৃর্ত্তিপাশা, জগদিশপুর, শাখাকাচি, কাচাবালিয়া, পোষন্ডা, ও গাগর এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে এ নৌ সাম্রাজ্য। কুড়িয়ানা হাটের ইজারাদার মোস্তফা কামাল জানান, ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত প্রকার ভেদে নৌকা বিক্রি হয় এ হাটে। জেলার বাইরে থেকে পাইকারদের বড় বড় ট্রলার এসে একসঙ্গে ১৮ থেকে ২০টি নৌকা কিনে তারা অন্য জেলায় নিয়ে বিক্রি করেন।

এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা যেহেতু নৌকায় করে খালের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, সে কারণেই ডিঙি নৌকার চাহিদা বেশি। জ্যৈষ্ঠ থেকে কার্তিক এ ছয় মাস আটঘর খালে প্রতি শুক্র এবং রোববার ক্রেতা-বিক্রেতার নৌকা ও বৈঠা বেচা-কেনা চলে। প্রতি হাটে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার নৌকা বিক্রি হয়। আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে ৩ কোটি টাকারও বেশি নৌকা বিক্রি হয়। বিক্রেতা নাদিম মিস্ত্রি জানান, প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে নৌকা তৈরির কাজ শুরু করেন যা চলে আশ্বিন মাসের শেষ পর্যন্ত। কিন্তু কাঠ সংকট, কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি ও গ্রামা লে নৌকা ব্যবহার কমে যাওয়ার কারণে নৌকা কারিগররা আগের মতো নৌকা তৈরিতে ক্রমশ আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।

কুড়িয়ানা বাজারে ঘরের সামনে বসেই নৌকা তৈরী করছেন ষাটোর্ধ্ব মোঃ আজিজুল হক। তাকে সাহায্য করছেন তারই পুত্র মোঃ মাহবুব হক মৃধা (৩০)। তারা জানান, নৌকা তৈরীর জন্য কাঠ সংকট। স্বমিলে গাছ কাটাতে গেলে সবসময় বিদ্যুত না পাওয়ায় অনেক সময় ধরে অলসভাবে বসে থাকতে হয়। গাছের সিএফটি প্রতি ১০/১২ টাকা বেড়ে গেছে। মিলে কাটাতে গেলে প্রতি কেবি গাছে গত বছরের চেয়ে ৫ টাকা করে বেশি দিতে হয়। এসব কারণে নৌকা তৈরী করে বিক্রি করতে গেলে চাহিদা অনুযায়ী দাম পাওয়া যাচ্ছে না।

আরেক নৌকা ব্যবসায়ী মোঃ মনিরুল ইসলাম জানান, বৈশাখ মাসের দিকে নৌকা তৈরীর মিস্ত্রিদের ঋণ হিসেবে টাকা (দাদন) দেয়া হয়। মিস্ত্রিদের কাছ থেকে নৌকা নেয়ার সময় বাজারমূল্য থেকে ৪ থেকে ৫শ টাকা কম দেয়া হয়।

বিনয়কাঠি থেকে নৌকা কিনতে আসা মোঃ আইউব আলী তালুকদার জানান, ৪৭শ টাকা দিয়ে একটি ডিঙি নৌকা কিনেছি। গরুকে ঘাস খাওয়ানোর জন্য সংগ্রহ করতে হলে পানির জন্য সমস্যা হয়। তাই নৌকায় করে ঘাস কেটে এনে খাওয়ানো যাবে। অন্যদিকে ইজারাদারদের অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসার সম্পূর্ণ মুনাফা ভোগ করতে পারছেন না কারিগর ও বিক্রেতারা।

এ অঞ্চলের নৌকা ব্যবসায়ীদের দাবি, তাদের যুগ যুগ ধরে চলে আসা ঐতিহ্যবাহী নৌহাট সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে নেয়া হোক সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ। এব্যাপারে ঝালকাঠি বিসিকের উপব্যবস্থাপক জালিছ মাহমুদ বলেন, ঝালকাঠি জেলার আওতায় নৌকা তৈরীর মিস্ত্রীরা ঋণ সহায়তা নিতে এলে নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top