করোনাভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করেছে। এতে বড়দের পাশাপাশি শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। তাই শিশুদের ব্যাপারেও এ সময় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
সতর্কতা ও শারীরিক যত্মের পাশাপাশি কোমলমতি শিশুদের মানসিক যত্মের বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে।
এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালের কনসালটেন্ট ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মাহমুদ হোসেন। লিখেছেন আঞ্জুমান আরা।
করোনায় শিশুদের ঝুঁকি কতটুকু জানতে চাইলে ডা. মাহমুদ হোসেন বলেন, করোনাভাইরাসে সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বয়সভেদে নয়, এটা সব বয়সেই হতে পারে। তবে এক বছরের কম বয়সের শিশুরা একটু বেশিই ঝুঁকিতে রয়েছে।
এ বয়সী শিশুরা যেহেতু বড়দের সংস্পর্শেই বেশি সময় থাকে তাই তাদের সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। শিশুদের ক্ষেত্রে উপসর্গগুলো খুবই কম থাকে। অনেক ক্ষেত্রে তা বোঝা যায় না। আর তাই চিকিৎসকের কাছেও সঠিক সময়ে যাওয়া হয় না।
তাছাড়া বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম। তাই করোনাকালে শিশুদের বিষয়ে অবশ্যই অতি সতর্ক থাকতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এ সময় শিশুদের কোনোভাবেই ঘরের বাইরে যেতে দেবেন না, কোনো আত্মীয় বাড়িতেও না অন্ততপক্ষে আগামী এক মাস। শিশুকে সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়ার নিয়ম শিখিয়ে দিন এবং বার বার হাত ধোয়ার অভ্যাস করান।
বাড়ির বড়রা যাদের রোজ কাজে বের হতে হচ্ছে বিশেষ করে চিকিৎসক, নার্স, জরুরি সেবায় নিয়োজিত তাদের কর্মস্থল থেকে ঘরে ফিরে প্রথমেই পরিধেয় পোশাক সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে এবং কুসুম গরম পানিতে গোসল করতে হবে।
এরপর পরিষ্কার কাপড় পরে শিশুর সংস্পর্শে যেতে হবে। বাড়িতে কেউ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে শিশুকে অবশ্যই আলাদা রাখতে হবে। যদি সেটা সম্ভব না হয় তবে তাকে অন্য কোনো আত্মীয় বাড়িতে নিরাপদ স্থানে রাখা যেতে পারে।
জরুরি প্রয়োজনে শিশুকে বাইরে নিতে হলে মুখে শিশুর উপযোগী মাস্ক পরিয়ে দিতে হবে। এ সময় শিশুদের ইমিউনিটি স্ট্রং করতে বেশি করে ফল খাওয়াতে হবে।
বিশেষ করে শিশুর দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় ভিটামিন ‘সি’ জাতীয় ফল রাখতে হবে।
শারীরিক সুস্থতায়
. শিশুর করোনাভাইরাসে সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে বাইরে যেতে দেবেন না। এখন স্কুল তো বন্ধই রয়েছে, পাশাপাশি শিশুর প্রাইভেট পড়ানো, নাচ-গানের ক্লাসসহ সব ধরনের ক্লাস বন্ধ রাখুন। বাড়িতে টিউটরও বন্ধ রাখুন।
. সরকার/হাসপাতাল/ডঐঙ দ্বারা প্রচারিত স্বাস্থ্যবিধি নিজে মানুন শিশুকেও অভ্যস্ত করুন। WHO নির্দেশিত পদ্ধতিতে শিশুকে ২০ সেকেন্ড ধরে এবং বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস করান। শিশুকে হাত দিয়ে নাক-মুখ-চোখ স্পর্শ না করা, হাঁচি-কাশি এলে টিস্যু দিয়ে নাক-মুখ ঢাকা এবং টিস্যু যথাস্থানে ফেলা, টিস্যু না থাকলে হাতের কনুইয়ের ভাঁজে হাঁচি-কাশি দেয়ার কৌশল শিখিয়ে দিন।
. খুব ছোট বাচ্চাদের বারবার হাত ধুয়ে দিতে হবে। যারা হামাগুড়ি দেয়, যাদের আঙুল মুখে দেয়ার অভ্যাস রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে মা-বাবাকে।
. করোনাভাইরাস এখনও ফুড বোর্ন নয়। তবুও ঘরে শিশু থাকলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে। শিশুর খাবার পাত্র, শিশুর খাবার পরিবেশনের আগে নিজের হাত, পাত্র যেখানে থাকবে সে জায়গাটি পরিষ্কার করতে হবে।
. করোনাকালে এমনিতেই ঘরবাড়ি জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। আর ঘরে যদি শিশু থাকে তবে ঘরবাড়ি জীবাণুমুক্ত রাখার ব্যাপারে আরও সতর্ক থাকতে হবে। বাড়ির মেঝে, দরজার হাতল, টেবিল, সুইচ ইত্যাদি জীবাণুনাশক দিয়ে দিনে কমপক্ষে দু’বার পরিষ্কার করতে হবে।
. অল্প হলেও শিশুদের শরীরচর্চার মধ্যে রাখুন। ঘরের মধ্যেই ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ, যোগব্যায়াম, অ্যারোবিক্স করাতে পারেন।
মানসিক সুস্থতায়
দীর্ঘমেয়াদি করোনাভাইরাসের আতঙ্কে এবং সংক্রমণে বড়দের মতো শিশুদেরও মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটছে। দীর্ঘদিন বাইরে যেতে না পেরে, ঘুরে বেড়াতে না পেরে শিশুদের মধ্যেও হতাশা, অস্থিরতা বাড়ছে।
সেই সঙ্গে বড়দের কাছে শুনে, নিউজ দেখে শিশুদের মধ্যেও করোনার আতঙ্ক জেঁকে বসেছে। যার পরিণতি কোমলমতি শিশুদের মারাÍক হতে পারে। তাই এ সময় শিশুর শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতার বিষয়ে জোর দিন। এজন্য যা করতে পারেন,
. এ সময় শিশুরা গৃহবন্দি। বড়দেরও অধিকাংশ সময় ঘরেই কাটছে। ঘরে আছেন বলেই শিশুদের সারাবেলা পড়তে বসিয়ে রাখবেন না।
পড়াশোনার পাশাপাশি এ সময় শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করা, গল্পের বই পড়া, টিভিতে ভালো কোনো অনুষ্ঠান দেখা সর্বোপরি কোয়ালিটি সময় কাটানোর দিকে নজর দিন;
. করোনা আতঙ্কে এবং গৃহবন্দি থাকায় শিশুর মধ্যে উদ্বিগ্নতা, অতিরিক্ত রাগ, পরিবারের সদস্যদের থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখা, চুপচাপ থাকা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই এ সময় আপনার শিশুর প্রতিক্রিয়াগুলোকে সহজভাবে নিয়ে তার কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনুন এবং যথাসম্ভব বেশি বেশি আদর করুন;
. এ সময় পত্রপত্রিকায়, টেলিভিশন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত নানা সংবাদে শিশুরা ভীত-উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে পারে। তাদের আশ্বস্ত করুন। বলুন, দেশে এই সংক্রমণ হচ্ছে বলে যে সবারই হবে, তা নয়। সংক্রমিত বেশির ভাগ রোগীই যে সেরে ওঠে তা জানান।
তাই বলে শিশুকে কিছু ভুল বোঝাবেন না। অহেতুক সান্ত্বনা দিতে গিয়ে এমন কিছু বলবেন না, যা পরে ভুল প্রমাণিত হয় এবং আপনার ওপর থেকে শিশুর বিশ্বাস উঠে যায়;
. শিশুর সামনে নিজেকে অতিরিক্ত আÍবিশ্বাসী বা খুব চিন্তিত রাখবেন না। দুটোই শিশুর মনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে;
. শিশুকে ছবি আঁকা, গানের চর্চা, বাগান পরিচর্যাসহ বিভিন্ন ধরনের গঠনমূলক কাজে ব্যস্ত রাখুন;
. বহু স্কুল এসময় অনলাইন ক্লাসের আয়োজন করছে, অবশ্যই সেগুলোতে অংশ নিতে উৎসাহ দিন। এতে শিশুদের পড়াশোনাও চলবে আবার স্কুলের প্রিয় শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সহপাঠীদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগও হবে;
. বাড়ির বিভিন্ন কাজে শিশুদের শামিল করুন। এতে শিশুর সময় ভালো কাটবে আর ঘরের কাজও শেখা হবে।