আসামে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়ার পর পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে দেখা দিয়েছে প্রবল এনআরসি আতঙ্ক। এরই মধ্যে জণগণনাপঞ্জী হালনাগাদ এবং রেশন কার্য সংশোধনের কাজ শুরু হয়েছে। পাশাপাশি বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি চালু হবেই বলে লাগাতার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমিত শাহ পর্যন্ত দেশজুড়ে এনআরসি চালু করার ইঙ্গিত দেওয়ায় এনআরসি নিয়ে আতঙ্ক আরও চরমে পৌঁছেছে। যদিও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের মানুষকে অভয়বাণী দিয়ে বলেছেন, তিনি বেঁচে থাকতে এনআরসি রাজ্যে চালু করতে দেবেন না। এমনকি রাজ্যেও মানুষকে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ কিছুতেই এনআরসি আতঙ্ক থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারছেন না। আর তারই পরিণতিতে গত এক সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। সবক্ষেত্রেই পরিবারের লোকজন, এনআরসি আতঙ্ককেই দায়ী করেছেন। আবার এই মৃত্যু নিয়েও রাজনৈতিক তরজা চলছে। পশ্চিমবঙ্গের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেছেন, বিজেপির এনআরসি নিয়ে প্রচারের জন্য মানুষ আতঙ্কে ভুগছেন। আবার মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস অভিযোগ করেছেন, দিলীপ ঘোষেরাই তো আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন।
এই সব মৃত্যুর দায় তাঁদেরই। পাল্টা বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সভাপতি দিলীপ ঘোষ এর জন্য সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দায়ী করে বলেছেন, কেউ দুর্ঘটনায় বা ঋণে মারা গেলেও এনআরসি বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এরপর কেউ মারা গেলে যদি এনআরসির নামে চালিয়ে দেওয়া হয়, তবে তার দায় মুখ্যমন্ত্রীর। মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এফআইআর করা উচিত। গত এক সপ্তাহে যে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে তাদের মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনায় ৪জন, জলপাইগুড়িতে ৩ জন, কোচবিহারে ২জন এবং দক্ষিন ২৪ পরগণায় ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদেও অধিকাংশই আত্মহত্যা করেছেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। এছাড়াও নথি সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন সরকারি অফিসে লাইনে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়ে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
গত মঙ্গলবার জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলায় একদিনে চারজন আত্মহত্যা করেছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জানা গিয়েছে, কেউ হারিয়ে ফেলেছিলেন ভোটার কার্ড, কেউ খুঁজে পাচ্ছিলেন না অন্য নথি। কারও আবার ভোটার কার্ডে এক নাম, রেশন কার্ডে আর এক। সরকারি অফিস থেকে নথি যোগাড়ের চেষ্টা কওে ব্যর্থ হয়েও এক জনের মৃত্যু হয়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। কোচবিহারের অর্জিনা বিবির যেমন বিভিন্ন নথিতে বিভিন্ন নাম ছিল বলে জানিয়েছেন তাঁর পরিবারের লোকেরা। এই নিয়ে তাঁর স্বামীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছিল। এরপরেই মঙ্গলবার তাঁর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। পরিবারের দাবি, এনআরসি আতঙ্কেই এই আত্মহনন। ধূপগুড়ির ভ্যানচালক শ্যামল রায় ভোটার কার্ড হারিয়ে আতঙ্কে ভুগছিলেন, বলেছেন তাঁর স্ত্রী। তাঁর দাবি, সেই ভয়েই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আত্মহত্যা করেন শ্যামল। জলপাইগুড়ি সাবের আলির পরিবারও এই একই যুক্তি দেখিয়েছেন। আবার দিনহাটার সামসুল হকের পরিবারের দাবি, বিভিন্ন নথিপত্র যোগাড়ে কয়েক দিন ধরে ছোটাছুটি করছিলেন তিনি। উৎকণ্ঠিতও ছিলেন। সোমবারই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মঙ্গলবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ময়নাগুড়ির অন্নদা রায়ও আত্মঘাতী হয়েছেন এনআরসি আতঙ্কেই, পরিবারের দাবি। রবিবার বসিরহাটের সোলাদানার বাসিন্দা কামাল হোসেন মন্ডলের দেহ পাওয়া গিয়েছে গাছের ডাল থেকে ঝুলন্ত অবস্থায়। পরিবারের অভিযোগ, এনআরসি আতঙ্কেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন। শনিবার রাতে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন শাসন থানার চকআমিনপুরের বাসিন্দা আয়েপ আলি । ’৭১ সালের আগের নথি না পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। এনআরসি আতঙ্কে শুধু বসিরহাটেই এক নারীসহ মোট তিন জনের মৃত্যুর খবর জানা গেছে। উত্তর ২৪ পরগনার শাসনেও ফপায়েশ াারি নামে এক ব্যক্তি নথির খোঁজ না পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। একই ভাবে নথির অভিাবে আত্মঘাতী হয়েছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার ফলতার কাশেম মোল্লøা। এদিকে প্রয়োজনীয় নথি যোগাড়ের জন্য সাধারণ মানুষ পাগলের মত সরকারি অফিসে ভিড় করছেন। কলকাতা পুরসভাতেও মানুষ জন্মেও সার্টিফিকেট যোগাড়ের জন্য লাইন দিচ্ছেন। গ্রাম বাংলার ছবিটি আরও করুণ। সেখানে প্রতিটি সরকারি অফিসে হাজার হাজার মানুষ লাইন দিচ্ছেন। ভোটার কার্ড সংশোধন ও নতুন রেশন কাযর্ড সংগ্রহের জন্যও মানুষ মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এমনকি রাজ্য সরকারের কেন্দ্রীয লাইব্রেরিতে গিয়েও মানুষ পুরনো ভোটার লিস্টের কপি সংগ্ররের জন্য লাইন দিচ্ছেন।