Monday , 23 December 2024
সংবাদ শিরোনাম

স্বজনদের কবরে বেঁচে ফেরাদের স্মৃতিচারণা

ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে জানাজা ঘর পেরিয়ে উত্তর দিকে কিছুটা হাঁটতেই দেখা গেল লাল ফিতা দিয়ে ঘেরা অনেকগুলো কবর। এর মধ্যে ১৪টি কবরে লাশ দাফন সম্পন্ন হয়েছে আর বাকি ৬৬টি কবর খালি। কবরস্থানের ঠিকাদার কল্লোল গতকাল শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে জানান, বুধবার রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর বৃহস্পতিবার মোট ৮০টি কবর এখানে প্রস্তুত করে রাখা হয়। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার রাত প্রায় ৩টা পর্যন্ত আগুনে পোড়া ১৪টি লাশ দাফন করা হয়েছে।

এগিয়ে দেখা যায়, পাশাপাশি তিনটি নতুন কবর। সবচেয়ে ছোট্ট যে কবরটি সেটি শিশু শাহিদের। মাত্র তিন বছর বয়স ছিল মেয়েটির। আগুনে শাহিদ একা না, তার বাবা পুরান ঢাকার ডুরি আঙ্গুরি লেনের রাশেদুল ইসলাম মিঠু (৩৯) ও মা সেনিয়া ইসলামও (৩০) মারা গেছেন। তিনজনেরই কবর হয়েছে একসঙ্গে। কবরগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে মোনাজাতে মগ্ন ছিলেন একজন। নিজের নাম আব্দুল কাদির জানিয়ে তিনি বলেন, কবরগুলো তাঁর ভাগ্নে, ভাগ্নে বউ ও নাতির। মা-বাবা ও বোনকে হারিয়ে বেঁচে আছে পরিবারের ১১ বছরের ছেলে রামিন।

পাশের একটি কবরের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ সাফায়েত, সালমান, নিখিল ও হোসেন। তারা আরাফাতের কবর জিয়ারতে এসেছে জানিয়ে সাফায়েত বলে, ‘আমরা নাজিমউদ্দিন রোডের আরাফাত ইসমাইল সিয়ামের বন্ধু। গত বুধবার রাতে আমাদের আরেক বন্ধু রোহানের সঙ্গে মোটরসাইকেলে পুড়ে মারা যায়। আরাফাতের লাশ পাওয়া গেলেও রোহানের লাশ এখনো পাওয়া যায়নি বা শনাক্ত হয়নি।’ পাশের একটি নামফলকবিহীন কবর দেখিয়ে তারা জানায়, এটাই আরাফাতের কবর। কোনো কোনো গণমাধ্যমে এসেছে, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির বিবিএ দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র রোহান বোনের বিয়ের কেনাকাটা করতে গিয়েছিল। বুধবার রাতে দুটি মোটরসাইকেল করে পাঁচ বন্ধু মিলে চকবাজারে গিয়েছিল। একটি মোটরসাইকেলে ছিল আরাফাত ও রোহান, অন্যটিতে লাবিব, রমিজ ও সোহাগ।

গতকাল শুক্রবার বিকেলে আরাফাতের কবরের কাছে দেখা মেলে লাবিব, রমিজ ও সোহাগের। ছবি নিতে চাইলে কিছুতেই রাজি হলো না তারা। লাবিব কিছুটা প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, ‘গণমাধ্যমে বিয়ের কেনাকাটার যে খবর বেরিয়েছে সেটা সঠিক না। আমরা সবাই মিলে ডালপট্টিতে পনিরের চা খেতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে আসার সময় চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ট্রাফিক জ্যামে আটকে যাই। এ সময় মসজিদের নিচে হোটেলের পাশে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয়। শকওয়েভের ধাক্কায় আমরা বাইক থেকে পড়ে যাই। মনে হচ্ছিল চারপাশ থেকে দেয়াল ভেঙে আমাদের গায়ের ওপর পড়ছে। মাথায়, পিঠে, পায়ে আঘাত লাগে। মনে হচ্ছিল জমিনে আগুন লেগে গেছে।’

আজিমপুর কবরস্থানের দাপ্তরিক কাজের জন্য একটি অফিস রয়েছে। সেখান থেকে জানা যায়, কবরস্থানে যে ১৪ জনের লাশ দাফন করা হয়েছে তাদের সবাই পুরান ঢাকার বাসিন্দা।

তাদের মধ্যে মিঠু, সেনিয়া, শাহী ও আরাফাত ছাড়াও চকবাজারের ১৭ কেবি রুদ্র রোডের ৩২ বছর বয়সী মো. ইয়াসিন, কামরাঙ্গীর চরের পূর্ব ইসলামপুরের ৪৮ বছর বয়সী মো. ইসহাক, ২৬১/১ জেনেন শাহা রোডের ২৪ বছর বয়সী নয়ন খান, ১৬ নন্দ কুমার দত্ত রোডের ২৩ বছর বয়সী অসিউদ্দিন, ২৭/৩/এ আরএনডি রোডের ৪৬ বছর বয়সী মো. বেল্লাল হোসেন, ৩২/৩৩ ওয়াটার ওয়ার্কস রোডের ৫২ বছর বয়সী মো. জুম্মুন, ১৭/২ রহমতগঞ্জ লেনের ৩২ বছর বয়সী মোহাম্মদ আলী এবং একই ঠিকানার ৩১ বছর বয়সী মো. অপু রায়হান ও তিন বছরের শিশু আরাফাত এবং ২৬ আসগর লেনের ৩৫ বছর বয়সী জয়নাল আবেদিন বাবুল রয়েছেন।

ঠিকাদার কল্লোল আরো বলেন, ‘শুনেছি বেশ কয়েকজনের লাশ ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আবার শনাক্ত করার অপেক্ষায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গেও কিছু লাশ রয়েছে। ওই সব লাশ শনাক্ত হওয়ার পর হয়তো এখানে আনা হবে। সে কারণে লাল ফিতা দিয়ে ঘেরা এসব কবরে অন্য কোনো লাশ দাফন করা হচ্ছে না।’

কবরস্থানের নিরাপত্তাকর্মী সাইদুর রহমান বলেন, চকবাজারের আগুনে যেসব রিকশা ও সিএনজির চালক (সিএনজিচালিত অটোরিকশা) পুড়ে মারা গেছেন, তাদের লাশের খোঁজখবর হতে সময় লাগবে। রিকশা বা সিএনজি মালিকরা তাদের গাড়ি না পাওয়ার

বিষয়টি টের পাওয়ার পর চালকদের খোঁজখবর শুরু হবে।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top