রোহিঙ্গা সংকট অনন্তকাল ধরে চলতে পারে না, এই সমস্যার সমাধান করতেই হবে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এভাবেই জোরালোভাবে নিজের অবস্থান তুলে ধরলেন সংস্থাটির মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতারেস।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার এক বছর পূর্তিতে মঙ্গলবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে গুরুত্বপূর্ণ উন্মুক্ত আলোচনার আয়োজন করা হয়। জাতিসংঘ মহাসচিব গত জুলাই মাসে তাঁর কক্সবাজার সফরের সময় বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে যে মর্মস্পর্শী বর্ণনা শুনেছেন, এই সভায় তা তুলে ধরেন তিনি।
নিরাপত্তা পরিষদের চলতি আগস্ট মাসের প্রেসিডেন্ট যুক্তরাজ্যের আয়োজনে এতে আরও বক্তব্য দেন ইউএনডিপি’র অ্যাসোসিয়েট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর তেগেগনিঅর্ক গেট্টু এবং ইউএনএইচসিআর’র শুভেচ্ছা দূত ও বিশিষ্ট অভিনেত্রী মিজ কেইট ব্লানশেট। সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাজ্যের কমনওয়েলথ ও জাতিসংঘ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী লর্ড তারিক মাহমুদ আহমাদ।
নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি সদস্য রাষ্ট্রের বাইরে এই সভায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন।
মহাসচিব আরও বলেন, ‘সংকটটি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদ প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেটমেন্ট গ্রহণের সময় যে একতা দেখিয়েছিল, সেই একতা ধরে রাখতে হবে।’ এ ক্ষেত্রে কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার পূর্ণ বাস্তবায়নের কথা আবারও তুলে ধরেন তিনি। জাতিসংঘ এবং এর বিভিন্ন সংস্থাকে রাখাইন রাজ্যে বাধাহীন প্রবেশাধিকার দেওয়ার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানান জাতিসংঘ মহাসচিব। একবছর ধরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাঁর ব্যক্তিগত পদক্ষেপসহ জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে সকল ব্যবস্থা নিয়েছে, সেগুলোর কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
‘আমরা যেন আর ব্যর্থ না হই’- এমন আহ্বান জানিয়ে ইউএনএইচসিআর’র শুভেচ্ছা দূত মিজ কেইট ব্লানশেট বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদকেই দায়িত্ব নিতে হবে।’ এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতভেদের উর্ধ্বে উঠে নিরাপত্তা পরিষদের সকল সদস্যকে কাজ করার আহ্বান জানান ব্লানশেট।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন গত একবছরে রোহিঙ্গা ইস্যুটি সামনে রেখে এর সমাধানে কাজ করে যাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি ধন্যবাদ জানান। সংকট সমাধানে গত বছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্থাপিত পাঁচ দফা সুপারিশের কথা উল্লেখ করেন রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর এই সুপারিশমালার ভিত্তিতেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হতে পারে।’
মাসুদ বিন মোমেন আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মানবিক সহযোগিতা দেওয়ার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের পদক্ষেপসমূহের টেকসই বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও উদারভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে, এই সংকট একই সঙ্গে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা ও আশ্রয়দানকারী বাংলাদেশের জন্যে মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দেবে।’
‘গণহত্যার উদ্দেশ্যে নিয়ে পূর্ব নির্ধারিত এবং সুপরিকল্পিত পদ্ধতি অনুসরণ করেই অপরাধীরা এই হীন অপরাধ সংঘটিত করেছে’-মানবাধিকার কাউন্সিলের স্বাধীন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের রিপোর্টের এই উদ্বৃতি উল্লেখ করেন রাষ্ট্রদূত মাসুদ। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি করার জন্য দেশটিকেই এগিয়ে আসতে হবে।’ তার জন্যে তিনি চারটি সুপারিশ তুলে ধরেন।
সুপারিশগুলো হলো রাখাইন প্রদেশের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাম ও শহরগুলোতে প্রয়োজনীয় মানবিক ও উন্নয়নমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নে ইউএনডিপি ও ইউএনএইচসিআর-কে স্বাধীনভাবে ঢুকতে দিতে হবে, সীমান্তে আটকে থাকা কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত নিতে হবে এবং ফেরত না যাওয়া পর্যন্ত মিয়ানমারের পক্ষ থেকেই তাদেরকে মানবিক সহায়তা দিতে হবে; রাখাইন রাজ্যের আইডিপি ক্যাম্প উন্মুক্ত করে দিতে হবে এবং সেখানে আটকরা যাতে নিজ বাসভূমিতে স্বাধীনতা নিয়ে টেকসইভাবে প্রত্যাবর্তন করতে পারে তার ব্যবস্থা নিতে হবে; রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং হিংসার জন্ম দেয় এমন কর্মকাণ্ড দমন করতে হবে।
জোরপূর্বক বাস্ত্যুচ্যুত হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে দুঃখ ও দুঃস্বপ্নের এক বছর পূর্তিতে কক্সবাজারের ক্যাম্পে জড়ো হওয়া রোহিঙ্গা নর-নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের হাতে বিভিন্ন স্লোগান লেখা প্লাকার্ডের একটি ‘এক বছর কেঁদেছি, এখন আমি ক্রোধান্বিত’-এই বক্তব্য উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এই শোকানুভূতি এবং ক্রোধের প্রতিধ্বনি আজ এই কাউন্সিলেও আমরা শুনতে পেলাম।’
এ সময় জাতিসংঘে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত তাঁর বক্তব্যে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তাঁর দেশের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও নিজেদের অবস্থানের কথা তুলে ধরেন।