দেশি পেঁয়াজের বাইরে বর্তমানে ভোক্তার চাহিদা অনুযায়ী আমদানি করা হয় ভারত থেকে। ভারতের বাজারে পেঁয়াজের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। আমদানিতেও কোনো সমস্যা নেই। ২০১৬ সাল থেকে সরকার পেঁয়াজ আমদানির ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বর্তমানে বাজারে পর্যাপ্ত পেঁয়াজও রয়েছে। তার পরও এক সপ্তাহ ধরে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। মূলত আসন্ন ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে পাইকারি ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বাড়িয়ে দিচ্ছে পেঁয়াজের দাম, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে খুচরা বাজারে। আর আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভোক্তাসাধারণ। বেনাপোল, দিনাজপুর ও চট্টগ্রাম থেকে কালের কণ্ঠ’র প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন :
আমদানি বাড়লেও দাম কমেনি : কালের কণ্ঠ’র বেনাপোল (যশোর) প্রতিনিধি জানান, সরকার শুল্কমুক্ত সুবিধায় ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ দিলেও বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতায় পেঁয়াজের দাম বেড়েই চলেছে। বর্তমানে ভারতীয় পেঁয়াজ বেনাপোল বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা আর দেশি পেঁয়াজ ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে। অতিরিক্ত মুনাফালোভী বিক্রেতাদের কারসাজির কারণে অস্বাভাবিক হারে মূল্য বৃদ্ধিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ক্রেতাসাধারণ। বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় কোরবানির ঈদ সামনে রেখে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। তবে আমদানিকারকরা বলছে, ভারত থেকে উচ্চমূল্যে পেঁয়াজ আমদানি হওয়ার কারণে দাম বেড়েছে। ভারত থেকে নাসিক, হাসখালি, বেলেডাঙ্গা ও খড়কপুর জাতের পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। তবে দেশে নাসিক জাতের পেঁয়াজের চাহিদা বেশি।
সূত্র জানায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য পেঁয়াজের বাজারমূল্য ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে ২০১৬ সালে রোজার আগে সরকার পেঁয়াজের ওপর থেকে আমদানি শুল্ককর প্রত্যাহার করে। এরপর আর শুল্ককর সংযোজন হয়নি। তবে অতিরিক্ত লাভ করতে বিক্রেতাদের সিন্ডিকেট হঠাৎ করে অস্বাভাবিক হারে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতের রপ্তানিমূল্যে প্রতি মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে ২০৫ মার্কিন ডলারে। বাংলাদেশি টাকায় যা ১৭ হাজার ২০০ টাকা। এই হিসাবে কেজিপ্রতি আমদানি খরচ পড়ছে ১৮ টাকা। এলসি খরচসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে বেনাপোল স্থলবন্দর পর্যন্ত পেঁয়াজ পৌঁছাতে খরচ পড়ছে কেজিপ্রতি ২০ টাকা। আমদানি করা পেঁয়াজ বন্দর থেকে পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৩৫ টাকা।
বেনাপোল কাস্টমস সূত্র জানায়, সাতক্ষীরার ভোমরা শুল্ক স্টেশন দিয়ে বেশি পেঁয়াজ আমদানি হয় বাংলাদেশে। সেখানে ট্রাকজটের কারণে কিছু পেঁয়াজ বর্তমানে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে আমদানি হচ্ছে। বাজার সহনশীল রাখতে ও পেঁয়াজ আমদানি গতিশীল করতে বেনাপোল বন্দর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। গত ৫ থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ভারত থেকে চার হাজার ৭৩৮ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। যা এরই মধ্যে বেনাপোল কাস্টম হাউস থেকে ছাড় করে নিয়ে গেছে আমদানিকারকরা।
বেনাপোলের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট রয়েল এন্টারপ্রাইজের মালিক রফিকুল ইসলাম রয়েল বলেন, বর্তমানে বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ প্রতি মেট্রিক টন ২০৫ ডলার মূল্যে শুল্কায়ন করছে। সেই হিসাবে ভারতীয় রপ্তানি খরচ, ট্রাক ভাড়া দিয়ে বেনাপোল পর্যন্ত প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম পড়ছে ২০ টাকা। বেনাপোল থেকে ঢাকায় পাঠাতে খরচ পড়ছে প্রতি কেজিতে আরো তিন টাকা। সেই হিসাবে প্রতি কেজির দাম পড়ছে ২৩ টাকা। এর মধ্যে কিছু পেঁয়াজ পচে যায়, কিছু শুকিয়ে যায়। এ ছাড়া আগে ১৫ থেকে ২০ টন একটি ট্রাকে পাঠানো যেত। বর্তমানে ১৩ টনের বেশি ট্রাক মালিকরা নিতে চায় না। এর ফলে পরিবহন খরচ বেড়েছে। এসব কারণে আমদানিকারকরা পেঁয়াজ আমদানিতে উৎসাহ দেখাচ্ছে না। বাজারে চাহিদার তুলনায় পেঁয়াজ কম থাকায় দাম বেড়েছে বলে জানান তিনি।
আমদানিকারক শাহিন রেজা জানান, বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রির কারণে আমদানিকারকরা লাভবান হচ্ছে না। পাইকারদের সিন্ডিকেটের কারণে ক্রেতাদের বেশি দামে পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে।
বেনাপোল বন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানিকারক খুলনার হামিদ এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার নজরুল ইসলাম জানান, পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি টন ২০৫ থেকে ৩০০ মার্কিন ডলার মূল্য নির্ধারণ করা হলেও ওই দামে ভারতের বাজার থেকে পেঁয়াজ কেনা যায় না। অনেক সময় নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি, আবার কখনো কমও থাকে। এ কারণে মূল্যের তারতম্য হয়।
বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, ‘বাজার সহনশীল রাখতে ও পেঁয়াজের আমদানি গতিশীল রাখতে বেনাপোল বন্দর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমদানিকারকরা যে মূল্য ঘোষণা দিচ্ছে আমরা সেই মূল্যে শুল্কায়ন করে দিচ্ছি।’
ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে পেঁয়াজের বাজার চড়া : কালের কণ্ঠ’র দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের হাকিমপুর হিলি স্থলবন্দর দিয়ে পেঁয়াজের আমদানি বেড়ে দ্বিগুণ হলেও কোরবানির ঈদের অতিরিক্ত চাহিদাকে পুঁজি করে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম কেজিপ্রতি ছয় থেকে আট টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছে। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে হিলি স্থলবন্দরে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি বলে মন্তব্য ক্রেতাসাধারণের। এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি পেঁয়াজ (ট্রাক সেল) ২২ থেকে ২৪ টাকা দরে বিক্রি হলেও বর্তমানে তা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৯ থেকে ৩১ টাকা কেজিতে।
হিলি স্থলবন্দর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বন্দর দিয়ে আগে গড়ে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ ট্রাক পেঁয়াজ আমদানি হলেও বর্তমানে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ ট্রাক পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে। গত শনিবার থেকে গত বৃহস্পতিবার এই ছয় দিনে বন্দর দিয়ে ৩৬৫টি ট্রাকে সাত হাজার ৩০০ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। গতকাল শনিবারও প্রায় ৮০ ট্রাক পেঁয়াজ বন্দর দিয়ে প্রবেশ করেছে।
জানা গেছে, বন্দর দিয়ে ভারত থেকে নাসিক জাতের পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে। বাংলাহিলি বাজারে খবর নিয়ে জানা গেছে, পাইকারিতে পেঁয়াজের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। বর্তমানে ভারত থেকে আমদানি করা প্রতি কেজি পেঁয়াজ খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৩৩ থেকে ৩৫ টাকা কেজি দরে। গত সপ্তাহে এসব পেঁয়াজ ২৩ থেকে ২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল।
হিলি বাজারে পেঁয়াজ কিনতে আসা ক্রেতা আমজাদ হোসেন জানান, গত সপ্তাহে যে পেঁয়াজ ২০ থেকে ২২ টাকা কেজি দরে কিনেছি, কয়েক দিনের ব্যবধানে সেই পেঁয়াজ এখন ৩০ থেকে ৩৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এখনো কোরবানি ঈদের কয়েক দিন বাকি। এখনই যদি এমন দাম হয় তাহলে সামনে পেঁয়াজের দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে জানে! ভারতের বাজারে পেঁয়াজের দাম না বাড়লেও ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে বাড়িয়ে দিয়েছে।
হিলি স্থলবন্দরের পেঁয়াজ আমদানিকারক বাবলু রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোরবানির ঈদ এলে দেশের বাজারে পেঁয়াজের চাহিদা বেড়ে যায়। দেশীয় পেঁয়াজের সরবরাহ কম ও দাম বাড়তি থাকায় ভারতীয় পেঁয়াজের ব্যাপক চাহিদা থাকে। সেই বাড়তি চাহিদা মাথায় রেখে বন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানির পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরে পাথরবাহী ট্রাকের কারণে যানজট সৃষ্টি হওয়ায় পেঁয়াজবাহী ট্রাকগুলো সঠিক সময়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারছে না। আমাদের প্রচুর পরিমাণ পেঁয়াজ ভারতের পার্কিংয়ে আটকা পড়ে আছে। বন্দর দিয়ে চাহিদামতো প্রবেশ করতে না পারায় দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে।’
হিলি স্থলবন্দরের জনসংযোগ কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন বলেন, ‘দেশের বাজারে পেঁয়াজের চাহিদা বাড়ায় বন্দর দিয়ে আমদানি বেড়ে গেছে। আগে যেখানে গড়ে প্রতিদিন বন্দর দিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ ট্রাক পেঁয়াজ আমদানি হতো, এখন সেখানে গড়ে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ ট্রাক আমদানি হচ্ছে।
কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে বাড়ছে দাম : চট্টগ্রাম থেকে আসিফ সিদ্দিকী জানান, কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি এই বাজার বর্তমানে ভারতীয় পেঁয়াজের দখলে। চীন, পাকিস্তান কিংবা অন্য দেশের পেঁয়াজ বাজারে নেই। তবে মিসর থেকে একটি চালানে ছয় কনটেইনার পেঁয়াজ আনার খবর পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সেগুলো ছাড়ের অপেক্ষায়।
খাতুনগঞ্জের আড়তে গত সপ্তাহে ভারতীয় নাসিক জাতের পেঁয়াজের দাম বেড়ে কেজি ৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গতকাল শনিবার সকালেও সেটি ৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে বিকেলের পর দাম একটু কমে কেজি ৩৩ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতের বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়েনি। ভারত নতুন করে শুল্ক আরোপও করেনি। বাড়ানো হয়নি ন্যূনতম রপ্তানিমূল্য (এমইপি)। দেশে আমদানির পরিমাণও বেড়েছে। তার পরও দেশে পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এর মূল কারণ সামনে কোরবানির ঈদ।
জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জ কাঁচাপণ্য আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটু একটু করে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। বাজারে বর্তমানে ভারতের পেঁয়াজ ছাড়া অন্য দেশের পেঁয়াজ নেই। ফলে আমরা ভারতের পেঁয়াজের ওপরই নির্ভরশীল।
মোহাম্মদ ইদ্রিস আরো বলেন, ‘দেশের স্থলবন্দরে ভারতীয় পেঁয়াজ গত সপ্তাহে ৩০-৩১ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছিল, সেগুলো আমরা এখানে ৩৫ টাকায় বিক্রি করেছি। স্থলবন্দরে দাম কমেছে বলে শুনেছি, তবে তা জানা যাবে আজ রবিবার।’
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে সরাসরি পেঁয়াজ আমদানি করে না। দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে আসা পেঁয়াজ কমিশনে বিক্রি করে থাকে। ফলে ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বাড়া এবং কমা নির্ভর করে স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীদের ওপর।
ভারতের গণমাধ্যমের খবর বলছে, ভারতে পেঁয়াজের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার লাসাগাঁওয়ে পেঁয়াজের দাম আড়তে গত ১ আগস্ট প্রতি কুইন্টাল ৬৯৬ রুপি এবং ১০ আগস্ট প্রতি কুইন্টাল ৭৬৬ রুপিতে বিক্রি হয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেঁয়াজ আমদানিতে সরকার সব ধরনের শুল্ককর প্রত্যাহার করেছে এক বছর আগে। কোনো কারণ ছাড়াই তার পরও পেঁয়াজের দাম বাড়াচ্ছে ব্যবসায়ীরা।