নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ঘোষণা করা পুলিশের বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহের সাত দিন শেষ হয়েছে গতকাল শনিবার। এই এক সপ্তাহে সড়কের ট্রাফিক পয়েন্টগুলোতে অবস্থান নিয়ে এক লাখ ৭৬ হাজার ৫৯৪টি মামলা দায়েরই ছিল সাফল্য। লাইসেন্সসহ কাগজপত্র যাচাই করে করা হয়েছে এসব মামলা। এ সময় শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য সিগন্যাল মানা, ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার, লেন মেনে চলা, উল্টোপথে চলাচল প্রতিরোধ, গাড়ির ফিটনেস ও বডির অবস্থা যাচাই, সিএনজি অটোরিকশার ভাড়াচুক্তি বন্ধ এবং ইন্ডিকেটরসহ বাতির ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিশেষ কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।
গতকাল পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী ট্রাফিক সপ্তাহ আরো তিন দিন বাড়িয়ে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত পালনের ঘোষণা দিয়েছেন। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে কোমলমতি শিশু-কিশোররা পুলিশের চেতনাকে জাগ্রত করেছে। এখন আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
তবে পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, ৯০ শতাংশ মানুষই ট্রাফিক আইন মানে না। এমন পরিস্থিতিতে কঠোর আইন প্রয়োগ করে শৃঙ্খলা ফেরানোর ক্ষেত্রে ট্রাফিক সপ্তাহে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। এটা বেগবান করার জন্য আরো তিন দিন সময় বাড়ানো হয়েছে।
গত ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে বাসচাপায় হত্যার ঘটনায় ছাত্র-ছাত্রীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এর জের ধরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান নিয়ে যানবাহনের লাইসেন্সসহ কাগজপত্র যাচাই শুরু করে। এ সময় তারা সড়কে শৃঙ্খলা আনার জন্য বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়। শিক্ষার্থীদের কর্মসূচির সময় দেখা যায়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য ও আইন প্রণেতারাও অনেক ক্ষেত্রে আইন মানছেন না। এমন প্রতীকী কর্মসূচিতে দেশবাসীর মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে। সবার বিবেককে নাড়িয়ে দেয় শিশু-কিশোররা। এমন অবস্থায় গত ৫ আগস্ট বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহ ঘোষণা করে পুলিশ। এর স্লোগান হচ্ছে—‘ট্রাফিক আইন মেনে চলুন, ট্রাফিক পুলিশকে সহযোগিতা করুন; ট্রাফিক শৃঙ্খলা একটি জাতির সভ্যতার প্রতীক।’
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) সোহেল রানা কালের কণ্ঠকে জানান, ছয়টি মহানগর, আটটি রেঞ্জ ও হাইওয়ে পুলিশ মিলে গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে এক লাখ ৭৬ হাজার ৫৯৪টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ আইন অমান্যের কারণে চালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৬ হাজার ৭২৩টি। গাড়ির ফিটনেসসহ সমস্যার কারণে যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এক লাখ ২৯ হাজার ৮৭১টি। জরিমানা হয়েছে চার কোটি ৪৯ লাখ ৯ হাজার ২২৩ টাকা। ত্রুটির কারণে তিন হাজার ৭৭৭টি গাড়ি আটক করে ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গতকাল সপ্তম দিনে ১৬ হাজার ৪৪৮টি যানবাহন ও ছয় হাজার চালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। জরিমানা আদায় হয়েছে ৭১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। গতকাল ২৩৩টি যানবাহন ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে।
৯০ শতাংশ মানুষই আইন মানে না
গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘বিদেশে ৯৮ শতাংশ মানুষ আইন মানলেও আমাদের দেশে ৯০ শতাংশ মানুষ ট্রাফিক আইন মানে না। তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ তিনি বলেন, রাজধানী রাস্তাগুলো অপ্রশস্ত, কিন্তু গাড়ি বেশি। এ ছাড়া রোড মার্কিং স্বল্পতা, যেখানে-সেখানে পার্কিং, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। এত কিছুর মধ্যেই ট্রাফিক পুলিশ শৃঙ্খলা ফেরানোর কাজ করছে। স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল না থাকায় হাতের ইশারায় পুলিশকে কাজ করতে হচ্ছে। এতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুলে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘কোমলমতি শিশুরা আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। তাদের দাবি যৌক্তিক, ন্যায্য। তাদের বার্তা যৌক্তিক ছিল। আমরা তাদের চেতনাকে অন্তরে ধারণ করি। ওদের দাবিকে সামনে রেখেই ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চলমান ট্রাফিক সপ্তাহে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, নির্বিশেষে আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
গত দুই বছরের পরিসংখ্যান তুলে ধরে আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, এর আগে হাইড্রলিক হর্নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অপ্রতুল ছিল। গত দুই বছরে হাইড্রলিক হর্ন ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে ৪৪ হাজার ৪৮৫টি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া উল্টো পথে গাড়ি চালানোর ঘটনায় ৪৪ হাজার ১৬১টি যানবাহন ও চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের চিহ্নিত না করার বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে ডিএমপি কমিশনার বলেন, হামলাকারীদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। হামলার শিকার সাংবাদিকরা চাইলে মামলা করতে পারবেন।
চেকপোস্টে কঠোর পুলিশ, রাস্তায় ভিন্ন চিত্র
গতকাল ঢাকা শহর ঘুরে দেখা গেছে, পুলিশ ট্রাফিক সিগন্যালগুলোর কাছে তল্লাশি বসিয়ে গাড়ি আটকে যানবাহনের কাগজ যাচাই করছে। মামলা দায়ের করছে। সিগন্যাল পয়েন্টগুলোতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা করছে রোভার ও স্কাউটের সদস্যরা। এসব স্থানে শৃঙ্খলা কিছুটা থাকলেও শহরের অন্যান্য স্থানে সড়ক পারাপার, ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার, উল্টো দিকে চলা, ভিন্ন লেন আটকে রাখাসহ বিশৃঙ্খল চলাচল দেখা গেছে। গতকাল দুপুরে হাইকোর্ট ক্রসিংয়ে গিয়ে দায়িত্বরত স্কাউটদের ‘ডিএমপি ক্যাপ’ পরিয়ে দেন ডিএমপি কমিশনার। তিনি স্কাউটদের এ ধরনের কার্যক্রমের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে ডিএমপি কমিশনার বলেন, নগরবাসীকে সচেতন হতে হবে। ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার না করলে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাস্তায় বাস রেষারেষি করে চালানোর কারণে দুই শিক্ষার্থী প্রাণ হারিয়েছে। তাই চালক না হেলপার কে গাড়ি চালাচ্ছে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অবৈধভাবে গাড়ি পার্ক করা যাবে না। গাড়িতে বৈধ কাগজপত্র রাখতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি পাওয়া গেলে ডাম্পিং করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রুট পারমিটবিহীন গাড়ি চলতে দেওয়া হবে না। ট্রাফিক সপ্তাহে শৃঙ্খলা ফিরে আসছে কি না—প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা অনেকটাই ফিরে এসেছে, তবে তা অপ্রতুল। ঈদুল আজহার পরে ট্রাফিক পুলিশ অভিযান আরো জোরালো করবে। ট্রাফিক ব্যবস্থা টেকসই করার জন্য এ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু এখনো চুক্তিতে গাড়ি দেওয়ার কারণে চালকরা বেপরোয়া গাড়ি চালাচ্ছে। মালিকরা চালকদের মাসিক বেতনে গাড়ি চালানোর সুযোগ দিতে পারেন। শুধু আইন প্রয়োগ করে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না। সবার সহযোগিতা দরকার।’
ট্রাফিক পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এস এম মুরাদ আলী জানান, প্রতিটি সড়কে গাড়ি যাচাই করা হয়। সিগন্যাল পয়েন্টের কাছে এ ব্যবস্থা বেশি। তবে মাঝেমধ্যেও আছে। পুলিশের নজর এড়িয়ে যাতে কেউ আইন না ভাঙতে পারে সে ব্যাপারে সহায়তা করছে রোভার স্কাউটরা।