তপন কুমার দে
ইংরেজী ১৯৭১ খ্রিঃ ২৬ মার্চ পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যূদয় ঘটে। বৃটিশের ১৯০ বছরের ও পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের উপনিবেশিক শোষণের অবসান ঘটিয়ে বাংলার আপামর জনসাধারণ দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রাম করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করে ১৯৭১ খ্রিঃ ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীনতাত্তোর ৪১ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে, কিন্তু বাংলাদেশ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক দিয়ে এখনও স্থিতিশীল হতে পারেনি। শিক্ষার পরিবেশ নাই, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস। আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার ভুলুন্ঠিত। বাংলার শতকরা ৭০ ভাগ শোষিত ও বুভুক্ষূ মানুষ এখনও তাদের বাঁচার মৌলিক উপাদান- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও যোগাযোগের অভাবে দারিদ্রসীমার নীচে সাধারণভাবে দৈনন্দিন জীবন অতিবাহিত করে আসছে। জাতির এমনি ক্রান্তিলগ্নে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থান থেকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত ও স্বাধীনতাত্তোর ৪১ বছরের দীর্ঘ সময়ে মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন আবু বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তথা নিপীড়িত নির্যাতিত জনসাধারণের অর্থনৈতিক মুক্তিতে ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যে বলিষ্ট সংগ্রাম করে আসছেন তার ধারাবাহিক বর্ণনা প্রদত্ত হলো
মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন আবু এর বাল্য নাম ছিল আবু তাহের। ছোট বেলায় মা-বাবা তাকে আবু ডাকতেন। তিনি বাংলা ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ ৬ ফাল্গুন, মঙ্গলবার সকাল ১০ ঘটিকার সময় টাঙ্গাইল জেলার সাবেক সদর থানা বর্তমান দেলদুয়ার থানার সেহড়াতৈল গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। দাদা- মরহুম রিয়াজ উদ্দিন সরকার, দাদী- আমেনা খাতুন, নানা- কাজী এখলাস উদ্দিন, নানী- হালিমা খাতুন। তাঁর পিতা মৌলভী খোরশেদ আলী একজন সমাজ সেবক ও ধার্মিক ব্যাক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। ১৯৯৪ খ্রিঃ ১৪ আগষ্ট তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন যিনি সেহড়াতৈল গ্রামের পারিবারিক গোরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। তাঁর মাতা রাবেয়া খাতুন সেহড়াতৈল গ্রামে বসবাস করছেন। তিনি পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে দ্বিতীয়।
বড় ভাই মরহুম আবদুর রাজ্জাক জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ছিলেন। তিনি ১৯৯৭ খ্রিঃ ১৪ অক্টোবর তাঁর কর্মস্থল থেকে ঐ দিনের কাজ শেষে অন্যান্য দিনের ন্যায় বাসায় (সেহড়াতৈল গ্রামে) ফেরার পথে এক ভয়াবহ সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হন। মরহুম আবদুর রাজ্জাক সেহড়াতৈল গ্রামের পাবলিক গোরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। মৃত্যুর সময় তিনি স্ত্রী জুলেখা বেগম বকুল ছাড়াও ২ ছেলে ও ২ মেয়ে রেখে যান। তাঁরা হলেন- মোয়াজ্জেম হোসেন, পারুল আক্তার, পারভীন আক্তার এবং তানভীর হোসেন কাফি। ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন এর ছোট বোন অর্থাৎ তাঁর বাবা-মার তৃতীয় সন্তান ছাহেরা খাতুন আঙ্গুর, স্বামী আশরাফ আলী। তাঁর ৪ সন্তান যথাক্রমে সাইফুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম, ফরিদা আক্তার ও নাজমা আক্তার।
মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন আবু-র ছোট ভাই অর্থাৎ তাঁর বাবা-মা-র ৪র্থ সন্তান আসাদ ইবনে খোরশেদ (বাবু) একটি সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। তাঁর স্ত্রী জেস্মিন আরা, ছেলে এহসান শাহরিয়ার জ্যোতি ও মেয়ে আনিকা জাহিন খুশবু। ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন এর সর্বকনিষ্ট বোন অর্থাৎ তাঁর বাবা-মার ৫ম সন্তান নাসরিন সুলতানা রেনু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রী; স্বামী মোজাহারুল ইসলাম তাঁর দু সন্তান জোহরা খাতুন জেরিন ও রাশেদুল ইসলাম রনি।
মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন আবু বাংলা ১৩৮২ সালের ১ বৈশাখ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন তার বয়স ছিল ২৩ বছর। তাঁর স্ত্রী আঞ্জুমানআরা (হাওয়া)-র বয়স ছিল ১৭ বৎসর, যিনি তাঁর বাবা-মার অত্যন্ত আদরের- বর্তমানে একজন সুগৃহিনী। আঞ্জুমানআরা (হাওয়া) তাঁর ৯ ভাই, বোনের মধ্যে প্রথম। তাঁর ৬ ভাই যথাক্রমে মরহুম আতাউর রহমান, সারোয়ার হোসেন, আইয়ুব আলী, আফজাল হোসেন, আব্দুল বাতেন ও সাখাওয়াৎ হোসেন (বুলবুল) এবং বোন মমতাজ পারভীন ও মায়া পারভীন। ২০১১ খ্রিঃ ৯ জুন তাঁর শ্বশুর ইন্তেকাল করেন। ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন এর ৩ সন্তান। তন্মধ্যে ১ম সন্তান সামসুন্নাহার রুনা (৩৫) মানসিক প্রতিবন্ধী দু’বছর পূর্বে তিনি দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ২য় সন্তান কামরুন্নাহার এনা (৩৩) বিবাহিত এবং সরকারী ইডেন মহিলা কলেজের ইংরেজী মাষ্টার্সের ছাত্রী। তৃতীয় সন্তান মঞ্জুর হোসেন সেতু (২৫) ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র।
মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন আবু-র বয়স যখন ৪ বছর তখন তাঁর পিতা মরহুম মৌলভী খোরশেদ আলী টাংগাইল সদর থানার দেলদুয়ার ইউনিয়নের সেহড়াতৈল গ্রাম থেকে এসে কাতুলী ইউনিয়নের খরশিলা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। ফলে তিনি বাবা-মা ও বড় ভাই এর সাথে খরশিলা গ্রামে বসবাস আরম্ভ করেন। শৈশব থেকেই ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ৫ (পাঁচ) বছর বয়সে ১৯৫৮ খ্রিঃ তৎকালীন পাবনা বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার বোয়ালকান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হন। তাঁর মেধায় অভিভূত হয়ে শিক্ষকগণ তাঁকে শিশু শ্রেণী হতে সরাসরি দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রমোশন দেন। উক্ত স্কুল যমুনা নদীর ভাংগনের ফলে স্থানান্তরিত হলে তার বাবা মা তাঁকে টাঙ্গাইল সদর থানার হুগড়া ইউনিয়নের চকগোপাল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর ১৯৬৪ খ্রিঃ তাঁকে আনুহলা জুনিয়র হাই স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। উক্ত প্রতিষ্ঠান হতে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া সমাপ্ত করার পর তার বাবা-মা তাঁকে ১৯৬৭ সালে টাঙ্গাইল জেলার সাবেক সদর থানার ও বর্তমান দেলদুয়ার থানার ছিলিমপুরের এম.এ করিম উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি করে দেন।
মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন আবু-র বাবার পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা মোটামুটি ভালই ছিল। গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, সোনালী আঁশের সমাবেশে কৃষি নির্ভর পরিবার। তার বাবা পৃথক হয়ে খরশিলা গ্রামে বসবাস করার সময় যখন তাকে ৫ সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হয় তখন তাদের পরিবারের জীবনযাত্রার মান সাধারণ মধ্যবিত্তে এসে দাঁড়ায়। ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন এর দাদা সন্তোষ জাহ্নবী হাই স্কুল থেকে ১৯০৫ খ্রিঃ ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তাঁর বাবা করটিয়া হাই স্কুলে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তার বাবার বয়স যখন ৬ বছর তখন তার দাদা মারা যান। ফলে তাঁর বাবার লেখাপড়া তেমন হয়ে উঠেনি। পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে তার ভাই-বোনদের সকলেই সুশিক্ষিত।
ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন আবু যখন দশম শ্রেণীর ছাত্র অর্থাৎ ১৯৬৯ খ্রিঃ মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার পরীক্ষার্থী তখন পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসক ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দেশের সর্বত্র গণঅভ্যূত্থান ঘটে। শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানোর চেষ্টা করা হয়। শেখ মুজিবকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের জেলাখানায় বন্দী করে রাখা হয়। মাওলানা ভাসানী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া না হলে তিনি দু’লক্ষ লোকের মিছিল নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের জেলখানার তালা ভেঙ্গে তাঁকে মুক্ত করে আনবেন। এমনি পরিস্থিতিতে আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৩নং আসামী কমান্ডার আব্দুর রব এর ভাষ্যে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে কিছু সংখ্যক বাঙালী বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধূ শেখ মুজিবের পক্ষে আগরতলা মামলার কৌশলী ছিলেন বর্তমান গণফোরাম সভাপতি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনবীদ ড. কামাল হোসেন।
ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে নির্বাচনী পরীক্ষা (টেষ্ট) সমাপ্ত করেই ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন আবু টাঙ্গাইলের গণঅভ্যূত্থানে যোগ দেন। এ সময় তিনি মাওলানা ভাসানীর সান্নিধ্যে আসেন। সারা পূর্ব পাকিস্তানের এমন কণ্টকাকীর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে টাংগাইল জেলার পশ্চিম এলাকাব্যাপী ডাকাত দমন আন্দোলনের সূত্রপাত হলে তিনি তাতে যোগ দেন। ক্রমে ঐ আন্দোলন গণআন্দোলনে পরিণত হয়। মাত্র তিন দিনের গণআন্দোলনে বা গণঅভ্যূত্থানে প্রায় ৬৭ জন ডাকাত মৃত্যুবরণ করে। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৬৯ খ্রিঃ মার্চ মাসে আইয়ুব শাহী ইয়াহিয়ার নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের মাত্র কয়েকদিন পূর্বে টাঙ্গাইলের তৎকালীন অবাঙ্গালী মহকুমা প্রশাসক আবদুল্লাহ আল-মেনন এর নেতৃত্বে পুলিশ ও ই.পি.আর এর এক বিশাল বাহিনী পশ্চিম টাংগাইলে গমন করে গণআন্দোলনে নিহত ডাকাতদের ছয় জনের লাশ তুলে যখন টাংগাইল শহরের দিকে রওনা হয় তখন তিনি মাত্র ৭/৮ জন ছাত্র সহ ১০/১২ হাজার জনসাধারণের বিশাল বাহিনী নিয়ে ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে তাদের গতিপথ রুদ্ধ করে দাঁড়ান। এমন গণঅভ্যূত্থানের মধ্যে প্রায় এক ঘন্টা বাকবিতন্ডার পর মহকুমা প্রশাসক পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে উক্ত ৬টি লাশ ছাত্রদের তথা জনসাধারণের নিকট হস্তান্তর করে টাংগাইল চলে আসেন। ১৯৬৯ খ্রিঃ ২৫ মার্চ আইয়ুব খান সেনাবাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করায় সামরিক শাসন জারী হলে সারা পশ্চিম টাংগাইলে ব্যাপক ধরপাকড় আরম্ভ হয়। ছাত্র জনতার অনেকে গ্রেফতার হন। পাক সামরিক বাহিনী তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করে। নিরীহ জনসাধারণের উপর নির্যাতন বন্ধ করার জন্য তিনি ন্যাপ এর সভাপতি মাওলানা ভাসানীর শরনাপন্ন হন। মাওলানা ভাসানীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি আয়ত্বে আসে।
নির্বাচনী পরীক্ষার পর তিনি আর লেখাপড়া করতে পারেননি। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব শাহী ও ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়ার ফলে গ্রেফতার এড়ানোর জন্যে তাকে একটানা ৬ মাস পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। পলাতক অবস্থায় তাঁকে ১৯৬৯ খ্রিঃ এস.এস.সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। যার ফলে তিনি এস.এস.সি পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল লাভ করতে পারেননি। এ সময় তার বন্ধুদের অনেকে পাক সেনা কর্তৃক বন্দী হন এবং জেলাখানা থেকেই এস.এস.সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন।