কারওয়ান বাজার, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দপ্তর। দ্বিতীয় তলায় হাতের ডানের শুরুর কক্ষটি আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (জোন-৫, কারওয়ান বাজার) এস এম অজিয়র রহমানের। সকাল ১১টা বাজার আগে থেকেই তাঁর কক্ষে এসে বসতে শুরু করেছেন টিভি ও পত্রিকার সাংবাদিকরা। একটু পরই ম্যাজিস্ট্রেট নেতৃত্ব দেবেন বাজার অভিযানে। এ কারণে একটু পর পর সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী লেখা পোশাক পরা দু-তিনজন করে এসে জটলা পাকাচ্ছেন, আবার নিচে চলে যাচ্ছেন। এর মধ্যে রুম থেকে একজন বের হয়ে তিন পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে বিদায় করলেন। নিচে গিয়ে কাইয়ুম নামের এক কর্মী অন্য একজনকে বললেন, ‘তোমার কোনো দোকান রাস্তায় থাকলে সরাইতে বলো। নইলে সমস্যায় পড়ব। সময় আছে, বলে আসো।’
নির্ধারিত সময়ের প্রায় আধাঘণ্টা পর ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর লোকবল (পুলিশ, এপিবিএন সদস্য, আনসার) নিয়ে দোতলা থেকে যখন নামলেন, তখন টিভির ক্যামেরাগুলো দৌড়ে গিয়ে সামনে থেকে ভিডিও করা শুরু করে। চারপাশের উত্সুক জনতা ক্যামেরাগুলোর দৌড়ঝাঁপ দেখে আরো উত্সুক হয়ে ওঠে। এ অবস্থাতেই ম্যাজিস্ট্রেট কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটে ঢোকেন। মার্কেটে ঢোকার ঠিক আগমুহূর্তে এক আনসার সদস্য (নাম লেখা ফরিদুল) পাশের লিচু ও আম বিক্রেতাদের বলছিলেন, ‘সরে যাও, নইলে কিন্তু ধরা খাবা। মোবাইল কোর্ট চইলা গেলে আবার আইসা বইসো।’
ম্যাজিস্ট্রেট প্রথমেই যান নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রির দোকানগুলোতে। এর একটি হাজি স্টোর। দোকানটিতে মূল্যতালিকা থাকলেও সেটা প্রকাশ্যে রাখা ছিল না। এ অপরাধে তাকে দোষী সাব্যস্ত করেন ম্যাজিস্ট্রেট। দোকানি মো. কামাল হোসেন কাকুতি-মিনতির ফাঁকে দুই হাতে নিজের দুই কানও ধরে ফেলেন মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে। ম্যাজিস্ট্রেট জানালেন, সম্ভব না, কারণ দুই দিন আগেও তাঁকে সতর্ক করা হয়েছিল। হাজি স্টোরকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এদিকে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট ও মিডিয়ার সরব উপস্থিতি দেখে মুদি দোকান ও পাশের চালের দোকানগুলোতে পটাপট মূল্যতালিকা ঝোলানো হয়ে গেছে। সুতরাং এখানে আর কেউই এ অপরাধে ধরা খেলো না।
পাশেই মাংসের দোকান। গিয়ে দেখা গেল, সব দোকানেই সিটি করপোরেশন নির্ধারিত মাংসের দাম লেখা লেমিনেটিং করা কাগজ ঝোলানো। বিক্রেতারা বললেন, নির্ধারিত দামেই বিক্রি হচ্ছে মাংস। ম্যাজিস্ট্রেট একজন ক্রেতা খুঁজে বের করলেন, যিনি মাংস কিনছিলেন। ক্রেতা জানালেন, গরুর মাংস ৪৫০ টাকায়ই কিনছেন তিনি।
কিচেন মার্কেটের পেছনে দুই সারিতে বেশ কয়েকটি মুদি দোকান। ব্যবসায়ীরা মালামাল দোকানের চেয়ে রাস্তার ওপরই বেশি রেখেছে। ফলে হাঁটার রাস্তার বেশির ভাগই দখল হয়ে গেছে। এখানে মূল্যতালিকা লুকিয়ে রাখার কারণে আনোয়ারা ট্রেডার্সকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এরপর রাস্তায় মালামাল রাখার অপরাধে নিউ হাজি মিজান স্টোরসহ দুটি দোকানকে পাঁচ হাজার করে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানা করা হলেও তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়, এখন থেকে চারটি সারি না করে দুই সারিতে পণ্য রাখার জন্য।
এরপর রাস্তা বন্ধ করে মালামাল রাখায় আরো একটি দোকানকে জরিমানা করা হয়। এ সময় বৃষ্টির পানি ঠেকাতে টানানো শামিয়ানাগুলো সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা চাকু দিয়ে কেটে দেন। এ সময় ওই পরিচ্ছন্নতাকর্মী কাইয়ুম ম্যাজিস্ট্রেটকে জানালেন, মিনিট দশেক আগেও তিনি এসে এগুলো খুলে দিয়ে গেছেন, যা পুনরায় লাগানো হয়েছে।
কারওয়ান বাজারে শেডের নিচে বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা দোকানগুলোর পাশেই একটি রাস্তায় কাঁচাবাজার বসে। মাঝেমধ্যেই সেখানে বুলডোজার দিয়ে সব ভেঙে দেওয়া হয়। আবার বসে একই বাজার। এখানে সব সবজিই খুচরা বিক্রি হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবার সেখানে গেলেন। একজন বেগুন বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলেন, বেগুন কত টাকা কেজি? বিক্রেতা জানালেন, ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতা নিজে থেকেই যোগ করলেন, ‘স্যার ৫৫ টাকা কেনা, ৬০ টাকায় বিক্রি করছি।’ পাশ থেকে একজন বললেন, ‘স্যার পাইকারিতে ৩০-৩৫ টাকা, ও মিথ্যা বলছে। এ সময় ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে আঠার মতো লেপ্টে ছিলেন কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র আড়ত কাঁচামাল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক (ভিজিটিং কার্ডে উল্লেখ রয়েছে ৯টি ব্যবসায়ী সমিতি ও ক্লাবের বিভিন্ন পদধারী) ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. লোকমান হোসেন। তিনি বলে উঠলেন, ‘স্যার চলেন। নিত্যপণ্যের দাম অন্তত স্বাভাবিক রয়েছে।’
তবে এই প্রতিবেদক অভিযান শেষ হওয়ার প্রায় আধাঘণ্টা পর সেই বেগুন বিক্রেতার কাছে গিয়ে দাম জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘৮০ টাকা কেজি। কয় কেজি দেব?’ আপনি না একটু আগে ম্যাজিস্ট্রেটকে বললেন ৬০ টাকা দাম? তিনি বললেন, ‘ওখানে নিম্নমানের কিছু বাছা বেগুন ছিল। সেগুলো ৬০ টাকা বলেছি।’ সেগুলো এখন নেই—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শেষ হয়ে গেছে মামা।’
ম্যাজিস্ট্রেট অভিযানের শেষ দিকে কিচেন মার্কেটের সামনের মুরগির দোকানগুলোতে হানা দিয়েছিলেন। তবে তিনি পৌঁছার আগেই ড্রাম ও মুরগির ড্রেসিংয়ের রক্তমাখা ট্রে সরাতে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। এর পরও একজন ট্রের মধ্যে মুরগির পাখনা, পা, কলিজা, মাথা খোলা অবস্থায় রেখেছিল। জিএম ব্রয়লার হাউসের সেই বিক্রেতাকে এর জন্য জরিমানা গুনতে হয়।
অভিযান শেষ হলে এস এম অজিয়র রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সিটি করপোরেশন নিয়মিত বাজার মনিটর করছে এবং করবে।’ অভিযান শুধুই রমজানকেন্দ্রিক কেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ সময় দাম বাড়ানোর অভিযোগটা বেশি থাকে। তাই এ সময় অভিযানটাও বেশি হয়। তবে সারা বছরই অভিযান চলে।’
অভিযান শেষে অবশ্য মাংসের দোকানগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, নির্ধারিত মূল্যেই মাংস বিক্রি হচ্ছে।