গ্রীষ্ম, বর্ষা কিংবা শীত—তিন সময়েই বাংলাদেশে এখন মৌসুমি ডায়রিয়ার প্রকোপ নিয়মিত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া সারা বছরও কমবেশি এ ডায়রিয়ার কবলে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। খাবার স্যালাইন কিংবা হাতের নাগালে যেকোনো হাসপাতালের চিকিৎসার ভরসায় ডায়রিয়ার প্রতি মানুষের আগের মতো ভয় এখন আর নেই। তবে এই ডায়রিয়ার ভেতর এখনো ভয়ের কারণ রয়ে গেছে কলেরা। বিশেষ করে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশই কলেরায় আক্রান্ত থাকে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এর প্রকোপের মাত্রা দিনে দিনে আরো বাড়ছে বলেও তাঁদের অভিমত।
এদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে এক পর্যালোচনাসভায় বলেন, দেশের সার্বিক ডায়রিয়া পরিস্থিতি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সব সরকারি হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য চিকিৎসক, নার্স প্রস্তুত আছে এবং পর্যাপ্ত ওষুধ ও স্যালাইন মজুদ আছে।
ওই সভায় জানানো হয়, এ বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় সারা দেশে এখনো ডায়রিয়ার প্রকোপ কম। তবে ঢাকা বিভাগে ডায়রিয়া রোগীর হার বেশি।
বিশেষজ্ঞরা জানান, ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্তরা কলেরায় আক্রান্ত হলে তাদের জীবনও মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ে। আর এ আক্রান্ত হওয়ার জন্য প্রধানত দায়ী করা হয় দূষিত বা অনিরাপদ পানিকে। তবে শুধু পানের জন্য ব্যবহৃত পানিই নয়, বরং খাদ্য প্রস্তুত থেকে শুরু করে সব কাজেই ব্যবহৃত পানি নিরাপদ হতে হবে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই এখনো ডায়রিয়ার পাশাপাশি কলেরার বিস্তার ঘটছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে বাংলাদেশসহ বিশ্বেরে ৬৯টি দেশে প্রতিবছর ২৯ মিলিয়ন মানুষ কলেরার কবলে পড়ে, যাদের মধ্যে বছরে প্রায় এক লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে।
এদিকে রোগতত্ত্ববিদ ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত রোগের ওপর কাজ করা এক দল গবেষক বাংলাদেশে দ্রুত সময়ের মধ্যে কলেরা আরো ভয়াবহভাবে ফিরে আসতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন। এ গবেষণার কাজে স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করে কলেরা বিস্তারের সমর্থনে নানা তথ্য-উপাত্ত পেয়েছে দলটি।
রোগতত্ত্ববিজ্ঞানী এবং সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নানা কারণে কলেরার বিষয়টি এখন আলোচনায় আসছে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে—আমরা দেশ থেকে কলেরাকে নির্মূল করতে পারিনি বরং তা আরো বেশি করে জেঁকে বসছে। সাধারণ মানুষ ঠিক ডায়রিয়া আর কলেরার পার্থক্য বুঝতে না পারলেও চিকিৎসক বা গবেষকরা কিন্তু ঠিকই তা শনাক্ত করতে পারছেন। অবশ্য সাধারণ মানুষও একটু সচেতন থাকলেই বুঝতে পারবে—যে ডায়রিয়ার রোগীর ক্ষেত্রে বারবার টয়লেটের সময় মলের পরিবর্তে কেবলই পানির মতো কিছু বের হবে, ওই রোগীর কলেরার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। আবার তাদের ডিহাইড্রেশনও খুব দ্রুত হয় এবং যত দ্রুত সম্ভব তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে।’
বর্তমানে আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) পরামর্শক ড. মাহামুদুর রহমান আরো জানান, এখন ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশই কলেরায় আক্রান্ত। এই প্রকোপ আরো বাড়ছে। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনিরাপদ পানিই মূলত দায়ী। একদিকে যেমন সাপ্লাই পানির পাইপ বেশির ভাগ সময়ই পরিষ্কার বা পরির্তন করা হয় না; সেখানে যেমন জীবাণুর ঘাঁটি থাকে আবার ওই জরাজীর্ণ পাইপ ছিদ্র হয়ে আশপাশের মল-মূত্রের লাইনের অথবা স্যুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। এ ছাড়া নানা পথখাবারের মাধ্যমেও অনিরাপদ পানি থেকে মানুষের দেহে কলেরা বা ডায়রিয়ার জীবাণু ঢুকে পড়ছে। এককালে গ্রামে কলেরার প্রকোপ বেশি থাকলেও এসব কারণে এখন শহর এলাকার মানুষের মধ্যেই কলেরার প্রকোপ বেশি দেখা যাচ্ছে।
কলেরা বিশেষজ্ঞরা বলেন, কলেরায় আক্রান্ত হলে শরীরে পানিশূন্যতার মাত্রা খুব তীব্রতর হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে তাত্ক্ষণিকভাবে কিডনিসহ অন্যান্য প্রত্যঙ্গ বিকল হতে পারে, যার পরিণতিতে মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি হয়। এমনকি যেকোনো কলেরা আক্রান্ত মানুষ মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যেও মারা যেতে পারে। আর একজন মানুষের শরীর কলেরায় চূড়ান্ত পর্যায়ে আক্রান্ত হলে তার মাধ্যমে আরো তিনজন সংক্রামিত হতে পারে। তবে আক্রান্ত হওয়ার পর দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া গেলে আর ভয় থাকে না।
আইসিডিডিআরবি সূত্র জানায়, এই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব এক হাসপাতাল জরিপের উপাত্ত অনুসারে কয়েক বছর ধরেই তাদের হাসপাতালে আগত প্রতি চারজন রোগীর মধ্যে একজন কলেরায় আক্রান্ত ছিল। আবার কলেরায় আক্রান্তদের মধ্যে গড়ে ১৮ থেকে ২০ শতাংশ রোগী থাকে শিশু। আর আইসিডিডিআরবির হাসপাতালে আসা সব রোগীর মধ্যে সর্বাধিক ‘ভিব্রিও কলেরি-০১’ জীবাণুই বেশি ছিল।
বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. রুহুল আমীন কালের কণ্ঠকে বলেন, শিশুদের এমনিতেই রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে, সে ক্ষেত্রে ডায়রিয়ার ঝুঁকিও থাকে অনেক বেশি; যাদের মধ্যে বড় একটি অংশ কলেরার জীবাণুতে আক্রান্ত হয়। কিন্তু শিশুদের খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে যদি সতর্কতা অবলম্বন করা হয় তবে এ বিপদ থেকে সুরক্ষা সম্ভব। বিশেষ করে খাওয়ার আগে ভালো করে হাত ধোয়া, শিশুদের বাইরের খাবার না খাইয়ে ঘরে তৈরি সম্পূরক খাবার খাওয়ানো এবং ছয় মাস বয়স পর্যন্ত অন্য কোনো কিছু মুখে না দিয়ে কেবল মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে পারলে কলেরার কোনো জীবাণুই শিশুকে আক্রান্ত করার সুযোগ থাকে না।
আইইডিসিআরের বর্তমান পরিচালক অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা কালের কণ্ঠকে বলেন, কলেরাসহ পানিবাহিত সব রোগ থেকে মুক্তির জন্য নিরাপদ পানির কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে স্যানিটেশন কাঠামো বা সিস্টেমের উন্নতি হলেও সাপ্লাই চেইনে কোথাও যদি জীবাণুযুক্ত পানির সংযুক্তি ঘটে যায় তবেই বিপদ বয়ে আনে। তাই এ ক্ষেত্রে সবাইকে নিরাপদ পানির ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘ইমপ্রুভিং ফুড সেফটি অব বাংলাদেশ’ কার্যক্রমের সিনিয়র ন্যাশনাল অ্যাডভাইজার ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, কলেরা শুধু পানিবাহিত রোগই নয়, এটিকে খাদ্যবাহিত রোগও বলা হয়। কারণ এই জীবাণু যে শুধু খাবার পানিতেই সীমাবদ্ধ আছে তা নয়, বরং ওই পানি দিয়ে যেকোনো খাবার প্রস্তুত, হাত ধোয়া, কিংবা থালা-বাসন ধোয়ার কাজ করলেও তা প্রক্রিয়াগত কারণেই মানুষের দেহে প্রবেশ করতে পারে। ফলে শুধু খাবার পানিকে নিরাপদ করলেই চলবে না, রান্না বাদে সব কিছুতেই নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হবে।
এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ উদাহরণ দিয়ে বলেন, কলেরা বা ডায়রিয়াসহ যেকোনো জীবাণুযুক্ত পানি দিয়ে যদি একটি ফল ধুয়ে দেওয়া হয় সেই ফল খেলে তো ওই জীবাণু পেটে যাবেই। তাই এ জন্য প্রয়োজন ফুটানো পানি ঠাণ্ডা করে তা ব্যবহার করা অথবা অন্য কোনো নিশ্চিত নিরাপদ পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া।
এদিকে স্যাটেলাইট প্রযুক্তিভিত্তিক এক দল গবেষক বঙ্গোপসাগরসহ দেশের ভেতরে কয়েকটি এলাকার নদ-নদী ও প্রাকৃতিক পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন; যেখানে তাঁরা দেখিয়েছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও তাপমাত্রাজনিত প্রভাবের কারণে দ্রুত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের বেশির ভাগ এলাকার পানির অবস্থা এমন হবে, যা কলেরার জীবাণুর জন্য খুবই উপযোগী থাকবে। ফলে ওই পানির মাধ্যমে মানুষের শরীরে কলেরার বিস্তার ঘটবে।
এরই সম্পূরক আরেকটি গবেষণার মাধ্যমে আরেক দল গবেষক স্যাটেলাইট ও সেলফোনের মাধ্যমে কলেরার প্রকোপের আগাম পূর্বাভাস দেওয়ার উপায় বের করেছেন। আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়নের ‘আর্থ অ্যান্ড স্পেস সায়েন্স’ জার্নালে এই গবেষণার ওপর একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে গত মার্চ ও এপ্রিল মাসে; যেখানে বাংলাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও বিদেশি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা অংশ নিয়েছেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মুখেও গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ের ডায়রিয়াসংক্রান্ত সভায় বলতে শোনা যায় ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও নগরায়ণের ফলে নদী বা জলাশয়ের পানি দূষিত হচ্ছে। ফলে পানিবাহিত ডায়রিয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। অন্যদিকে উন্মুক্ত স্থানে খাবার গ্রহণও এই রোগের অন্যতম কারণ। এ জন্য সাধারণ মানুষকে পানি ফুটিয়ে খাবার জন্য এবং খাবার আগে হাত ধোয়াসহ সব সতর্কতামূলক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।