রাজধানীর কদমতলী থানার শ্যামপুরে স্যুয়ারেজের খোলা ম্যানহোলে পড়ে মারা যাওয়া শিশু ইসমাইল হোসেন নীরবের (০৬) ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। শিশুটি ম্যানহোলে পড়ার ১০ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যেই শ্বাসরোধ হয়ে মারা যায় বলে জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) ফরেনসিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান ডা. কাজী।বুধবার সকালে ঢামেকের ফরেনসিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান ডা. কাজী মো. আবু সামা, সহকারী অধ্যাপক ডা. একেএম শফিউজ্জামান, প্রভাষক ডা. প্রদীপ বিশ্বাস ও ডা. খবির সোহেলকে নিয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড ময়নাতদন্ত করেন।ময়নাতদন্ত শেষে ডা. কাজী মো. আবু সামা বলেন, ম্যানহোলে পড়ে যাওয়ার ১০ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে মৃত্যু হয় শিশু নিরবের। ম্যানহোল থেকে স্রোতে ভেসে যাওয়ার কারণে শিশুটির শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঁচড়ের দাগ পাওয়া গেছে।এর আগে মঙ্গলবার বিকাল পৌনে ৪টার দিকে খেলা করার সময় শিশুটি বাড়ির অদূরে ম্যানহোলে পড়ে যায়। ম্যানহোলের মধ্যে শিশু পড়ে যাওয়ার খবরে আশপাশের হাজার হাজার মানুষ ঘটনাস্থলে জড়ো হন। স্থানীয় অনেকে শিশুটিকে উদ্ধারের জন্য নেমে পড়েন ম্যানহোলে। অনেকে নীরবের জন্য প্রার্থনা করতে থাকেন। ততক্ষণে খবর পেয়ে সেখানে ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিসের বেশ কয়েকটি ইউনিট। আসেন ফায়ার সার্ভিসের অন্তত ২০ জন ডুবুরি। তারা স্যুয়ারেজ লাইনে নেমে শিশুটিকে উদ্ধারের প্রাণপণ চেষ্টা চালান। তবে স্যুয়ারেজ লাইনে আশপাশের শিল্পকারখানার বর্জ্য ও পানির তীব্র সোতের কারণে উদ্ধারকাজ বিলম্ব হয়। এর মধ্যেই পানির তোড়ে ভেসে যায় শিশু নীরব। প্রায় চার ঘণ্টা প্রাণান্ত চেষ্টার পর ঘটনাস্থল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে রাত ৮টার দিকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরসংলগ্ন স্লুইস গেটে দেখা মেলে নীরবের নিথর দেহ। স্লুইস গেটে স্যুয়্যারেজ লাইনের যে অংশটি বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে মিশেছে সেখানেই আটকে ছিল সে। খবর পেয়ে উদ্ধারকর্মীরা সেখানে ছুটে যান। নীরবকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। হাসপাতালে আনার পর রাত ৯টা ১২ মিনিটে চিকিৎসক ডা. সোহেল রানা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর তার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়।নিরবের চাচা সোহরাব হোসেন জানান, প্রতিবেশী হৃদয়সহ কয়েক শিশুর সঙ্গে খেলছিল নীরব। স্যুয়ারেজের ঢাকনাবিহীন স্থানে দাঁড়ানো অবস্থায় পেছন থেকে অন্য এক শিশু ধাক্কা দিলে নীরব উপুড় হয়ে স্যুয়ারেজে পড়ে যায়। খবর পেয়ে তারা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে স্যুয়ারেজে নামলেও নীরবকে খুঁজে পাননি। পরে ফায়ার সার্ভিসে খবর দিলে বিকাল ৪টার পরে এসে তারা উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে। নিরবের মা নাজমা অভিযোগ করেন, রাতুল নামের এক শিশু তার ছেলেকে ধাক্কা দেয়।ওয়ারী বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার সৈয়দ নুরুল ইসলাম ঘটনাস্থলে জানান, স্যুয়ারেজটি পাশে ৪ ফিট এবং গভীর ৭ থেকে ৮ ফিট। ম্যানহোলের ব্যাসার্ধ ছিল দেড় ফুট। ভেতরে স্যুয়ারেজ লাইনটি ছিল তিন ফুট ব্যাসার্ধের। এতে তীব্র স্রোত ছিল। এঁকে বেঁকে যাওয়া লাইনটি দক্ষিণে পোস্তগোলা ব্রিজের পাশ দিয়ে গিয়ে বুড়িগঙ্গার সঙ্গে মেশে। এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূরত্ব হবে। বিকালে পড়ে যাওয়া শিশুটিকে রাত সোয়া ৮টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল উদ্ধার করে।তিনি আরও জানান, পড়ে যাওয়ার পর শিশু নীরব সেরদের ৫ থেকে ৭টি দল দফায় দফায় তল্লাশি শুরু করে স্যুয়ারেজ লাইনের ভেতরে। তবে স্যুয়ারেজের ভেতর পানি ময়লা ও বিষাক্ত এবং অনেক সে াত থাকায় উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হয়। শ্বাসরুদ্ধকর উদ্ধার অভিযান চালিয়ে তাকে বুড়িগঙ্গা নদী সংলগ্ন স্লুইস গেটের নেটে আটকে থাকা অবস্থায় উদ্ধার করা হয় নীরবের নিথর দেহ। ডিসি নুরুল ইসলাম জানান, স্যুয়ারেজের উপর ঢাকনা থাকলেও তা কিছুটা সরিয়ে রাখা হয়েছিল। সোমবার লাইনটি পরিষ্কার করা হয়। এরপর সেটি পুরোপুরি ঢাকনা না দিয়েই রেখে দেয়া হয়েছিল। ফলে ওই ফাঁকা অংশ দিয়ে শিশু নীরব পড়ে যায়। সেটি ওয়াসার না স্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানের সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।ডিসি ওয়ারী আরও জানান, ওই এলাকায় বেশ কিছু স্যুয়ারেজ ও ম্যানহোল অরক্ষিত অবস্থায় দেখা গেছে। দীর্ঘদিন ধরেই এ অবস্থা পুরো এলাকায়। অরক্ষিত এসব ম্যানহোল ও স্যুয়ারেজ মেরামতে সংশ্লিষ্টদের কোনো উদ্যোগ নেই।জসিম নামের এক উদ্ধার কর্মী জানান, বিকাল ৪টা থেকে শিশু নীরব জীবিত উদ্ধার করার জন্য স্যুয়ারেজের ভেতরে ডুবুরিরা প্রবেশ করে। স্যুয়ারেজটি দক্ষিণ দিকে পোস্তগোলা ব্রিজের পাশ দিয়ে গিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে মিশেছে। স্যুয়ারেজের ভেতর দিয়ে ব্রিজ পর্যন্ত গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয় ও উদ্ধার কর্মীরা জানান, শিশুটি যে ম্যানহোলে পড়েছে সেটি মূলত কলকারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য। ম্যানহোলটিতে প্রচণ্ড সে াত ছিল। পড়ে যাওয়ার পরপরই স্রোতের টানে ভেসে যায়। বিষাক্ত বর্জ্যে শিশুটির করুণ মৃত্যু হয়।সূত্রে আরও জানা গেছে, শিশুটি যে স্থানে পড়ে গেছে ওই স্যুয়ারেজ লাইনটি বুড়িগঙ্গার যে স্থানে মিলিত হয়েছে সে স্থানটিতে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল নামেন। সন্ধ্যার আগ থেকেই ওই এলাকায় লাইটের মাধ্যমে আলোর ব্যবস্থা করে শিশুটিকে খোঁজা হয়। স্যুয়ারেজ লাইনটি অনেক বড় এবং এর ভেতরে প্রচণ্ড স্রোত থাকায় শিশুটির খোঁজ পাওয়া যায়নি। স্যুয়ারেজ লাইন কেটে কেটে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা চালানো হয়। পড়ে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে শিশুটি উদ্ধার হয়।স্থানীয়রা জানায়, শিল্প কলকারখানার বর্জ্য অপসারণের জন্য তৈরি ম্যানহোলটি দীর্ঘদিন ধরে অরক্ষিত ছিল। ম্যানহোলের উপরে ঢাকনা (স্লাব) দীর্ঘদিন ধরে ভাঙা থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা মেরামতে উদ্যোগ নেয়নি। ম্যানহোলটিতে ঢাকনা থাকলে এই দুর্ঘটনা ঘটত না।এদিকে নীরবের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ায় ক্ষোভে ফুঁসে উঠতে শুরু করেছে স্থানীয়রা। তার আগেই ওই এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও র্যাব সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ওসি এনায়েত হোসেন জানান, শ্যামপুরে পরিত্যক্ত ম্যানহোলে একটি শিশু পড়ে যাওয়ার খবর পেয়ে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে ফায়ার সার্ভিস। তাদের ৫টি ইউনিট উদ্ধার তৎপরতা চালায়।কদমতলী থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী জানান, শিশুটিকে উদ্ধারে দমকল বাহিনীর কর্মীরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। নীরবের বাবার নাম রেজাউল ইসলাম। তিনি আরএফএল গ্রুপের মেকানিক। তাদের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানায়। সাত বছর আগে একই এলাকার নাজমা বেগমের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। নাজমা-রেজাউল দম্পতির একমাত্র ছেলে ছিল নীরব। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর রাজধানীর শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে গভীর পাইপের ভেতর পড়ে যায় জিহাদ নামের এক শিশু। ওই ঘটনার দীর্ঘ ২৩ ঘণ্টা পর ওয়াসার গভীর নলকূপের পাইপ থেকে শিশু জিহাদকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে রাত ৯টায় কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সোহেল রানা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।