যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন-ফ্রান্স সিরিয়ায় একযোগে যে হামলা চালিয়েছে, আন্তর্জাতিক আইনের চোখে তার বৈধতা কতটা? এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি বিশ্লেষণ করেছেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক মার্ক ওয়েলার।
এর পক্ষে দেশ তিনটি যেসব যুক্তি দেখাচ্ছে, তা প্রধানত জোর দিচ্ছে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার ওপর। তারা বলছে, এ হামলার লক্ষ্য প্রেসিডেন্ট আসাদের রাসায়নিক অস্ত্রের মওজুদ ধ্বংস করা এবং সিরিয়ায় বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে এ রকম রাসায়নিক হামলা প্রতিরোধ করা।-খবর বিবিসি অনলাইন।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ব্রিটেন সবসময় বিশ্বের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এটি ব্রিটেন করেছে নিজেদের জাতীয় স্বার্থ এবং সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বার্থে।
কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে বিচার করলে, এসব যুক্তি কিন্তু বিশ্বকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় জাতিসংঘ সনদ গৃহীত হওয়ার পূর্ববর্তী সময়ে।
জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী, কোনো দেশ আত্মরক্ষার্থে এবং কোনো জনগোষ্ঠী, যারা নির্মূল হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছে, তাদের রক্ষায় সামরিক বল প্রয়োগ করতে পারে।
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার মতো বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনেও বল প্রয়োগ করা যেতে পারে। কিন্তু সেটি হতে হবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন সাপেক্ষে।
তবে জাতিসংঘ সনদের এ ধারাটি কেবল ব্যবহার করা যাবে, যখন কোনো দেশ, যার বিরুদ্ধে সত্যিকারের বা আসন্ন হুমকি আছে, তার নিরাপত্তারক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেই।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটা চাল হিসেবে এটিকে যেন ব্যবহার করা না যায়, সেই ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা আছে জাতিসংঘের সনদে।
কাজেই ১৯৪৫ সালের জাতিসংঘ সনদপরবর্তী আন্তর্জাতিক আইনে প্রতিশোধ হিসেবে সামরিক বল প্রয়োগ বা কোনো দেশকে শিক্ষা দেয়ার জন্য সামরিক হামলা চালানো যায় না।
প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা তো নীতিগতভাবেই বেআইনি। তবে সেটিকে মেনে নেয়া যায় যদি তার লক্ষ্য হয় কোনো দেশকে আন্তর্জাতিক আইনকানুন মানতে বাধ্য করা।
১৯৮১ সালে ইসরাইল যখন ইরাকের পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা চালিয়ে সেটি ধ্বংস করে দেয়, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কিন্তু তার নিন্দা করেছিল এ কারণেই। ইসরাইলের যুক্তি ছিল এই পারমাণবিক চুল্লি ব্যবহার করে ভবিষ্যতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করা হতে পারে।
কেনিয়া ও তানজিনিয়ার মার্কিন দূতাবাসে বোমা হামলার জবাবে ১৯৯৮ সালে সুদানের এক কথিত রাসায়নিক অস্ত্র কারখানায় যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে দেয়। সেটিরও নিন্দা করেছিল জাতিসংঘ।
যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন-ফ্রান্স যুক্তি দিচ্ছে যে রাসায়নিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে সিরিয়াকে বাধ্য করতে তারা এ বিমান হামলা চালাচ্ছে। ২০১৩ সালে সিরিয়া রাসায়নিক অস্ত্র নিরোধ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সনদে সই করে।
কিন্তু এই সনদে সই করার পরও সিরিয়া তা লঙ্ঘন করে চলেছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে।
সিরিয়ায় এসব ঘটনা কীভাবে অর্গেনাইজেশন ফর দ্য প্রহিবিশন অব কেমিক্যাল উইপনস (ওপিসিডাব্লিউ) তদন্ত করবে, তা নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর বিরোধ দেখা দেয়।
তদন্তের ব্যাপারে রাশিয়ার প্রস্তাবে আপত্তি জানায় পশ্চিমা দেশগুলো। আর পশ্চিমা দেশগুলোর প্রস্তাবে ভেটো দেয় রাশিয়া। ফলে এ নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একটি অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে।
ঠিক এ রকম একটা অবস্থায় নিরাপত্তা পরিষদের তিন সদস্য, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স যুক্তি দিচ্ছে যে, রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের কারণে সিরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন পাওয়ার কোনো বাস্তব সম্ভাবনা নেই।
এ অবস্থায় সিরিয়ায় হামলা চালিয়ে তারা আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার কাজটিই করছেন। সেই সঙ্গে রাসায়নিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞাটি কার্যকর করছেন।
কিন্তু এ যুক্তিটি যেন ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের যুক্তিটিকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে। নিরাপত্তা পরিষদ ইরাকের ওপর কিছু অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।
সেই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়াই তখন যুদ্ধে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনসহ আরও কিছু মিত্র দেশ।
এবার যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন-ফ্রান্স সিরিয়ার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তাকে আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনে করে রাশিয়া।
অন্যদিকে জাতিসংঘ মহাসচিবও মনে করিয়ে দিয়েছেন যে নিরাপত্তা পরিষদের মুখ্য ভূমিকাকে সবার শ্রদ্ধা জানাতে হবে।