চালু হওয়ার ২৭ বছর আবার আলোচনায় এসেছে বহুনির্বাচনী প্রশ্ন বা এমসিকিউ পদ্ধতি। একসময় শিক্ষার মান ধস আনার জন্য এ পদ্ধতিকে দায়ী করেছেন অনেক। এবার প্রশ্নফাঁস রোধ করতে না পারার জন্য এ পদ্ধতিকে দায়ী করছেন কেউ কেউ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো: সোহরাব হোসাইন গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতিতে প্রশ্নফাঁস ঠেকানো সম্ভব নয়। এমসিকিউ পদ্ধতি বিষয়ে তিনি বলেন, আমি মনে করি এটি একটি ভালো উদ্যোগ। তবে পদ্ধতিটি খুবই ঝামেলা করছে। আমি মনে করি- প্রশ্নফাঁসের বিষয়ে অনেকাংশে দায়ী এমসিকিউ। আগামী বছর থেকে নতুন পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণের কথাও জানান তিনি।
১৯৯২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় চালু করা হয় এমসিকিউ পদ্ধতি। মুখস্থ নির্ভরতা কমানো এবং পরীক্ষায় নকল বন্ধে এটি সাহায্য করবে এ যুক্তি তখন সামনে আনা হয়। পরীক্ষায় নকল বন্ধ হলেও মুখস্থ নির্ভরতা না কমা এবং বাংলাদেশে শিক্ষার মানের অধঃপতনের জন্য দীর্ঘ দিন ধরে অনেকে এ পদ্ধতিকে দায়ী করেছেন। একই সাথে অনেকে এ পদ্ধতি বাতিলের পক্ষেও বলেছেন।
এবার চলতি এসএসসি পরীক্ষায় এখন পর্যন্ত টানা নবম দিন যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে তার প্রায় সবই এমসিকিউ প্রশ্নপত্র। এর আগেও বারবার ফাঁস হয়েছে এমসিকিউ প্রশ্নপত্র। এমসিকিউ প্রশ্নই যে বারবার ফাঁস হচ্ছে, তা নয় বরং শিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমানে সার্বিক যে নৈরাজ্য চলছে তার পেছনে এ পদ্ধতিও উল্লেখযোগ্যভাবে দায়ী বলে মনে করেন অনেকে। এমসিকিউ ঘিরে পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন কয়েক বছর ধরে আলোচিত একটি বিষয় ছিল। এর সাথে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছেন অনেক শিক্ষক। ফল প্রতিযোগিতায় লিপ্ত নামকরা অনেক স্কুলের শিক্ষকেরা পারস্পরিক আঁতাতের মাধ্যমে পরীক্ষার কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের উত্তর বলে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি পরীক্ষা শুরুর অনেক আগেই প্রশ্নের প্যাকেট খুলে উত্তর তৈরির সময় হাতেনাতে শিক্ষক ধরা পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। পাবলিক পরীক্ষার সময় বিভিন্ন পরীক্ষার হলে দেখা গেছে সব শিক্ষার্থী একত্রে বসে উত্তর তৈরি করছেন।
এসবের ভিডিও দৃশ্যও ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকেরা আঙুল উঁচু সঙ্কেতের মাধ্যমে উত্তর বলে দিচ্ছেন।
অনেক শিক্ষক অভিভাবক আক্ষেপ করে বলেছেন, এক সময় ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়া নকল প্রথা উঠে গেলেও পরীক্ষার হলে আবার ফিরে এসেছে ভিন্ন স্টাইলে। মূলত এমসিকিউ এবং সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঘিরেই চলছে এ নৈরাজ্য। শিক্ষক, অভিভাক ও শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, পরীক্ষার হলে বিশেষ করে গ্রামপর্যায়ে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের উত্তর শেয়ার করা, শিক্ষকের উত্তর বলে দেয়া মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে তীব্র হতাশা ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে। কারণ ঠিকমতো পড়াশুনা না করেও পরীক্ষার হলের নৈরাজ্যের কারণে ভালো ফল করছে অমেধাবীরা।
২৭ বছর ধরে চলা স্কুল ও কলেজপর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষায় এমসিকিউ বা বহুনির্বাচনী প্রশ্ন পদ্ধতি বহাল রাখা নিয়ে অনেক আগে থেকেই বির্তক শুরু হয়েছে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে এমসিকিউ পদ্ধতিটি ভালো হলেও সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাবে এর সুফল পাওয়া যায়নি। মুখস্থপ্রবণতা কমিয়ে পুরো বই ভালো করে অধ্যয়ন করার ওপর গুরুত্বারোপের চিন্তা থেকে এ পদ্ধতি চালু করা হয়। তবে সঠিক প্রশ্ন প্রণয়নের অভাবে মূলত শিক্ষার্থীরা এখনো মুখস্থ করেই এমসিকিউর উত্তর দিয়ে থাকে।
শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, এমসিকিউ পদ্ধতির কারণে ভালো-মন্দের পার্থক্য করা কঠিন হয়ে গেছে। বাস্তবে দেখা গেছে ক্লাসে একজন শিক্ষার্র্থীর ভালো পারফরম্যান্স না থাকা সত্তে¡ও পাবলিক পরীক্ষায় সে ভালো রেজাল্ট করছে। সহজে পাস করতে পারা, পাসের হার বৃদ্ধি এবং অধিক নম্বর পেলেও শিক্ষার্থীদের মানের উন্নতি হয়নি এ পদ্ধতিতে। বরং মানের অবনতি হয়েছে বলে মনে করেন তারা।
এমসিকিউ চালুর আগে শিক্ষার্র্থীদের ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা দিয়ে মেধা যাচাই করতে হতো। কিন্তু এমসিকিউ চালুর পর লিখিত পরীক্ষায় নম্বর রাখা হয় ৫০। দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় চলমান এ ধারা পরিবর্তন করে লিখিত পরীক্ষা থেকে ৫০ নম্বর কমিয়ে দেয়ায় গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় একটি আমূল পরিবর্তন আনা হয়। এমসিকিউ পদ্ধতি চালুর ফলে লিখন পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব কমে যাওয়ায় শিক্ষার্র্থীদের মানের অবনতি নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেয় শিক্ষক, অভিভাবক ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে। অনেকেই তখন আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এতে শিক্ষার্র্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অবজেকটিভ পদ্ধতি নামে ১৯৯২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় সর্বপ্রথম চালু হয় এমসিকিউ বা মাল্টিপল চয়েজ কোশ্চেন পদ্ধতি। চালুর পর থেকেই এ নিয়ে শুরু হয় তীব্র বিতর্ক ও সমালোচনা। কারণ বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় দেখা গেছে, কেউ যদি আন্দাজেও ১০০টি এমসিকিউ প্রশ্নের উত্তর দেয় তাহলে ২৫টি পর্যন্ত উত্তর সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। আবার চারটি প্রদত্ত উত্তর থেকে কেউ যদি শুধু ‘খ’ বা ‘গ’ উত্তরে টিক দেয় বা বৃত্ত ভরাট করে তাহলেও শতকরা ২০-২২টি উত্তর সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
শিক্ষকেরা জানান, এমসিকিউ পদ্ধতিতে খুব সহজে ভালো রেজাল্ট করা যায়। রেজাল্ট ভালো হচ্ছে কিন্তু এমসিকিউর কারণে শিক্ষার মান কমে গেছে। অনেক শিক্ষক আফসোস করে বলেন, আগের রচনামূলক পদ্ধতিই ভালো ছিল।
তবে কোনো কোনো শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞ এমসিকিউ পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়ে বলেছেন, পদ্ধতিটি বাতিল না করে ভালোভাবে প্রয়োগের চেষ্টা করা উচিত। একজন শিক্ষার্থী এমসিকিউ পদ্ধতিতে ভালো করতে চাইলে সে যেন অবশ্যই পুরো বই ভালো করে রপ্ত করতে বাধ্য হয়Ñ সেভাবে প্রশ্ন প্রণয়ন করা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক শাহ্ শামীম আহ্মেদ বলেন, পদ্ধতিটি ভালো ছিল। কিন্তু একে ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়নি। ফলে এর সুফল পাওয়া যায়নি। এমসিকিউ পদ্ধতিকে ভালোভাবে ব্যবহারের জন্য যে দক্ষ জনবল দরকার ছিল তা তৈরি করা যায়নি।
তিনি বলেন, কম সময়ে একজন শিক্ষার্থীর বেশি বিষয়ে মেধা যাচাই এবং বেশি তথ্য আদায়ের খুবই ভালো পদ্ধতি এমসিকিউ। এমসিকিউ পদ্ধতিকে ভালোভাবে ব্যবহার এবং এ থেকে সুফল পেতে দরকার ছিল সঠিক পদ্ধতিতে প্রশ্ন তৈরি করা। এমসিকিউ প্রশ্ন এমনভাবে করা দরকার ছিল; যাতে শিক্ষার্থীর বৃত্ত ভরাট বা টিক চিহ্ন দেয়ার চেয়ে চিন্তা করতে বেশি সময় ব্যয় করতে হয়। কিন্তু বর্তমানে এমনভাবে প্রশ্ন করা হয় যেখানে একজন শিক্ষার্থী প্রশ্নের প্রথম শব্দ দেখেই বুঝে যায় এর উত্তর কী হবে। ফলে এমসিকিউ পরীক্ষার জন্য যে সময় বরাদ্দ থাকে তার অনেক আগেই পরীক্ষা শেষ হয়ে যায় অনেকের। এ থেকে বোঝা যায় মুখস্ত প্রবণতাই এখানেও প্রাধান্য পাচ্ছে।
১৯৯২ সালে এমসিকিউ চালুর সময় একেকটি বিষয়ে ৫০০ প্রশ্নব্যাংক নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা বই না পড়েও গাইড থেকে ৫০০ প্রশ্ন মুখস্ত করেই ৫০ নম্বর নিশ্চিত করতে পারত তখন। সমালোচনার কারণে পরে নির্দিষ্ট ৫০০টি প্রশ্ন বাদ দেয়া হয়। বর্তমানে স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকেই এমসিকিউ পদ্ধতি চালু রয়েছে। এ ছাড়া এসএসসি ছাড়া এইচএসসিতেও এ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। পরে এমসিকিউতে ৪০ নম্বর করা হয়। ২০১৭ সাল থেকে আরো কমিয়ে ৩০ নম্বর নির্ধারণ করা হয় এ পদ্ধতির জন্য।