অর্থবছরের শুরুতে আগামী জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ব্যাংকঋণের জোগান প্রবৃদ্ধি ১৬.৩ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তবে অর্থবছরের মাঝামাঝি এসে এটি বাড়িয়ে ১৬.৮ শতাংশে প্রক্ষেপণ করে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি প্রণয়নের ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির চাপ উপশমের লক্ষ্যে বাজারে অর্থের সরবরাহ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নামিয়ে আনতে সরকারি খাতে ব্যাংকঋণের চাহিদা কম থাকায় অভ্যন্তরীণ ঋণের জোগান প্রবৃদ্ধি আগের মতো ১৫.৮ শতাংশে অপরিবর্তিতই রাখার নীতি ও কার্যক্রম গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন গভর্নর ফজলে কবির।
বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান প্রবৃদ্ধি বাড়ানো হয়েছে এমনটা দেখা গেলেও প্রকৃতপক্ষে আগামী ছয় মাসের জন্য বেসরকারি খাতে ঋণ জোগানের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কমানো হয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি ছিল ১৮.১ শতাংশ।
গতকাল সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের জাহাঙ্গীর আলম সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতির ঘোষণাপত্র পাঠকালে গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে ছিলেন চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট উপদেষ্টা আল্লাহ মালিক কাজেমী, ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান, এস কে সুর চৌধুরী, এস এম মনিরুজ্জামান, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. ফয়সল আহমদ প্রমুখ।
এবারের মুদ্রানীতির আলোচনায় আগে থেকেই গুরুত্ব পেয়েছিল ব্যাংকগুলোর অগ্রিম ও আমানতের অনুপাত (এডিআর) কমানোর বিষয়টি। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু না বললে একটি নির্দেশনা জারির আভাস দিয়েছেন গভর্নর। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ব্যাংকের জন্য আলাদা কোনো হার নির্ধারণ করা হতে পারে বা এডিআর ঠিক রেখে ব্যাংকের অন্যান্য রেটিং বিবেচনায় আমানতের তুলনায় ঋণ বিতরণ অনুপাত কমানো বা বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করা হতে পারে বলে জানান ফজলে কবির।
এ ছাড়া আমদানির বৈদেশিক পরিশোধ দায় বেড়ে যাওয়ার হার যতটা সম্ভব কমানোর চেষ্টার কথা জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেছেন, ‘নিট বৈদেশিক সম্পদের প্রবৃদ্ধি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের শেষে প্রায় শূন্যের কোঠায় (শুন্য দশমিক ১) দাঁড়াবে বলে প্রক্ষেপিত হয়েছে।’
গভর্নর আরো বলেন, ‘সরকারের ব্যাংকঋণ ব্যবহারের ঋণাত্মক ধারা রিজার্ভ মুদ্রার প্রবৃদ্ধি পরিমিত রেখে মূল্যস্ফীতি চাপ উপশমে সহায়তা দেবে। পাশাপাশি প্রায় শূন্যের কোঠার নিট বৈদেশিক সম্পদ প্রবৃদ্ধি ব্যাপক মুদ্রার প্রবৃদ্ধিকে আগের প্রক্ষেপিত ১৩.৯ শতাংশের চেয়ে অনেকটা কম ১৩.৩ শতাংশে পরিমিত রাখবে।’
মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে আমানতের নির্ধারিত অনুপাতের বেশি হারে ঋণ বিতরণের বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি জানিয়ে গভর্নর বলেন, ‘এ ধরনের দায়িত্বহীনতা রোধে ব্যাংক কম্পানি আইনের বিধানগুলোর কার্যকরী প্রয়োগ নিশ্চিত করা হবে।’
ঋণ কার্যক্রম ও বৈদেশিক পরিশোধ দায় সৃষ্টিতে কঠোরতর শৃঙ্খলা আরোপের ব্যবস্থার পাশাপাশি অর্থ ও মূলধন বাজারগুলোয় স্থানীয় ও বৈদেশিক উেসর তহবিল আকর্ষণের আরো কয়েকটি পদক্ষেপের কথা জানান গভর্নর। করপোরেট গ্রাহকদের মেয়াদি প্রকল্প বিনিয়োগ অর্থায়নে ব্যাংকগুলোর ওপর অতিনির্ভরতা কমিয়ে এনে এদের মূলধন বাজারে বন্ড ইস্যু করে অর্থ সংগ্রহে উৎসাহ ও সহায়তা প্রদানে ব্যাংকগুলোকে সক্রিয় করার কথা বলেন গভর্নর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ফয়সল আহমদ এ বিষয়ে বলেন, ‘নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে ব্যাংকের চেয়ে মূলধনী বাজার ভালো জায়গা। সে ক্ষেত্রে পুঁজিবাজার ও বন্ড মার্কেটকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ মেয়াদি ঋণের জন্য ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে অনেক দেশই ভুল করেছে। আমরা সেই ভুল করতে চাই না।’
এ ছাড়া অনিবাসী বাংলাদেশিদের বৈদেশিক সঞ্চয় ও আর্থিক বিনিয়োগ বাংলাদেশের অর্থ ও মূলধন বাজারমুখী করার জন্য তাদের কাছে আকর্ষণীয় মুনাফাবাহী সরকারি ওয়েজ আর্নার্স বন্ডের বিক্রি প্রসারে এবং অনিবাসী বিনিয়োগ টাকা হিসাব (নিটা) খুলে দেশের মূলধন বাজারে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ পরিচালনায় ব্যাংকগুলোকে উদ্যোগী করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন ফজলে কবির।
ইন্টারনেটভিত্তিক ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিদেশে পণ্য ও সেবা রপ্তানির আয় ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আনার প্রক্রিয়া সহজতর করার কার্যক্রম হাতে নেওয়ার কথা বলেন গভর্নর। এ ছাড়া প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ-সুবিধাদি প্রসারের পাশাপাশি বৈদেশিক দেশেই হুন্ডি কার্যক্রমে মোবাইল ফোন অ্যাকাউন্ট ব্যবহার প্রতিরোধের জোরালো কার্যক্রম হাতে নেওয়ার কথাও বলেন তিনি।
চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) নীতিভঙ্গি ও কার্যক্রমগুলো অর্জনের কয়েকটি দিক তুলে ধরে গভর্নর ফজলে কবির বলেন, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও উৎপাদন উপকরণাদির আমদানির জোরালো প্রবৃদ্ধি এসেছে, নভেম্বর ২০১৭ নাগাদ এ খাতের আমদানি প্রবৃদ্ধি ২০.৩ শতাংশ। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিও প্রক্ষেপিত ১৬.২ শতাংশ মাত্রা ছাড়িয়ে ডিসেম্বরে ১৮.১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গড় বার্ষিক মূল্যস্ফীতি পুরো বছরের ৫.৫ শতাংশ ঊর্ধ্বসীমার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ডিসেম্বর শেষে ৫.৭ শতাংশে রয়েছে। আমদানি ব্যয়ের আকস্মিক স্ফীতি বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের চলতি খাত ঘাটতি স্ফীত করে টাকার মূল্যমানে ২.৫ শতাংশ অবচিতির সঙ্গে রিজার্ভ স্থিতির ওপর চাপ বাড়িয়ে তুলেছে। এবারের মুদ্রানীতিকে কর্মসংস্থানমুখী প্রবৃদ্ধিসহায়ক মুদ্রানীতি বলে মনে করেন গভর্নর ফজলে কবির।