“এসব ‘শিটহোল’ দেশের লোকজন সবাই কেন আমাদের দেশে আসছে?”
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাকি হোয়াইট হাউজে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রেট দলীয় সিনেটরদের সাথে এক বৈঠকে এভাবেই হাইতি, এল সালভাদর এবং আফ্রিকান দেশগুলোকে বর্ণনা করেছেন। এই বৈঠকে তিনি সেনেটরদের সাথে অভিবাসন নিয়ে কথা বলছিলেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য এ শব্দটি ব্যবহারের কথা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু তারপরও ঘটনাটি সাংবাদিকদের রিপোর্ট করতে হয়েছে। আর এই ‘শিটহোলে’র অনুবাদ করতে গিয়ে বিশ্বজুড়েই সাংবাদিকরা বেশ বিপাকেই পড়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে ‘শিটহোল’ শব্দটি সরাসরি ব্যবহার করেনি অনেকে। সিএনএন এবং এমএসএনবিসি তাদের স্ক্রিনে শব্দটি ব্যবহার করেছে, কিন্তু সংবাদ উপস্থাপক ওলফ ব্লিটজার পুরো শব্দটি না বলে এর চেয়ে কম আপত্তিকর ‘এস হোল’ বলেই ক্ষান্ত দিয়েছেন।
কিন্তু বাকি দুনিয়ার সাংবাদিকরা কী করেছেন?
বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে কয়েক ডজন ভাষায় সংবাদ প্রচার করা হয়। সেই বিভিন্ন ভাষায় কিভাবে বর্ণনা করা হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের উচ্চারিত এই শব্দটি?
কিছু কিছু ভাষা বিভাগ ‘শিটহোল কান্ট্রিজে’র একেবারে আক্ষরিক অনুবাদই করেছে। বিবিসি মুন্ডু, যারা মূলত স্প্যানিশ ভাষায় দক্ষিণ আমেরিকার মানুষের জন্য রেডিও অনুষ্ঠান করে, তারা এটিকে অনুবাদ করেছে ‘পেইসেস ডে মিয়েরডা’ বা ‘মল বা বিষ্ঠার দেশ’ বলে।
বিবিসি তুর্কী ভাষা বিভাগ ‘শিটহোলে’র অনুবাদ কওেরছে ‘বোক কাকারু’ বা ‘মল ভর্তি গর্ত’ বলে।
বিবিসি ইন্দোনেশিয়া ভাষা বিভাগ জানিয়েছে, তাদের ভাষায় ‘শিটহোল’ হচ্ছে, ‘লোবাং কোটেরান’, অর্থাৎ ‘মলত্যাগের গর্ত। তারা সংবাদটি পরিবেশনের সময় তাই বলেছে।
বিবিসি ইন্দোনেশিয়ার লিস্টন সিরেগার বলেন, আমাদের শ্রোতাদের জন্য এটা সেরকম বড় কোনো ব্যাপার নয়। এটা একটা অভদ্র এবং বাজে শব্দ। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ায় কেউ যখন খুব রেগে যায়, তখন এরকম শব্দ ব্যবহার করে। তবে একজন রাজনীতিক বা প্রেসিডেন্টের মুখ থেকে এটা কেউ আশা করেন না।”
তবে অন্য অনেক ভাষা বিভাগ সরাসরি এই শব্দের আক্ষরিক অনুবাদ ব্যবহার করতে চাননি এটি খুবই অরুচিকর শোনাবে বলে।
উর্দূ ভাষা বিভাগ ব্যবহার করেছে ‘ঘাটিয়া’ বা টয়লেট শব্দটি।
বিবিসির ফার্সি বিভাগের সাংবাদিকরা ব্যবহার করেন ‘টয়লেটের মলভান্ড’ শব্দটি।
রুশ ভাষা বিভাগের ফামিল ইসমাইলভ বলেন, আমাদের ভাষায় এরকম শব্দ আমরা ব্যবহার করতে পারি না, এটা ইংরেজির চেয়েও অনেক বেশি আপত্তিকর শোনাবে।”
তারা এটির অনুবাদ হিসেবে ব্যবহার করেছেন ‘দূর্গন্ধযুক্ত গর্ত’।
ভিয়েতনামী বিভাগের সাংবাদিক থু ফ্যান বলেন, তারাও আক্ষরিক অনুবাদের পরিবর্তে টয়লেট শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তার মতে, যদি তারা আসল শব্দটি ব্যবহার করতেন, তাহলে হয়তো খবরটি ভাইরাল হয়ে যেতে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
কিন্তু ইংরেজি ভাষাতেই বা ‘শিটহোলে’র আসল অর্থ কী?
অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারী অনুযায়ী শিটহোলের এক নম্বর অর্থ আসলে ‘রেকটাম’ বা ‘অ্যানাস’, অর্থাৎ মানুষের মলদ্বার। এর তিন নম্বর অর্থ হিসেবে টয়লেটও আছে অবশ্য।
বিবিসির থাই সার্ভিস তাদের খবরে ‘শিটহোলের’ অনুবাদ হিসেবে ‘মলদ্বার’কেই বেছে নিয়েছে।
ট্রাম্পের ‘বর্ণবাদী মন্তব্যে’ বিশ্ব জুড়ে নিন্দার ঝড়
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হাইতি, এল সালভাদর এবং আফ্রিকার কিছু দেশকে খুবই স্থূল ভাষায় বর্ণনা করেছেন বলে অভিযোগের পর এর বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘ সহ বিভিন্ন দেশ।
হোয়াইট হাউসে কংগ্রেস সদস্যদের সাথে অভিবাসন নীতি নিয়ে এক বৈঠকের সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এসব দেশকে ‘শিটহোল’ বা ‘পায়খানার গর্তে’র সাথে তুলনা করেন বলে খবর দেয় মার্কিন গণমাধ্যম।
এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক নিন্দা এবং প্রতিবাদ শুরু হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য এরকম শব্দ ব্যবহারের কথা অস্বীকার করছেন।
কিন্তু ওই বৈঠকে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেট দলীয় একজন সেনেটর ডিক ডারবিন দাবি করছেন, তিনি প্রেসিডেন্টকে বর্ণবাদী শব্দ ব্যবহার করতে শুনেছেন। তিনি শুধু একবার নয়, কয়েকবার এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি কিছু আফ্রিকান দেশকে ‘শিটহোল’ বলে বর্ণনা করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট এবং ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল সহ অনেক সংবাদপত্রেই বৃহস্পতিবার এই খবর প্রকাশিত হয়। এর কোনো প্রতিবাদ হোয়াইট হাউজ থেকে করা হয়নি।
সেনেটর ডিক ডারবিন বলেন, “আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে গতকাল প্রেসিডেন্ট যে শব্দগুলো সেখানে ব্যবহার করেছেন, হোয়াইট হাউসের ইতিহাসে, ওই ওভাল অফিসে বসে এর আগে কখনো কোন প্রেসিডেন্ট তা বলেছেন।”
অভিবাসন নিয়ে গতকাল রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রেট দলীয় সেনেটরদের একটি দল একটি প্রস্তাব নিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়েছিলেন।
তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাকি তাদের বলেছিলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ বা এরকম বিপর্যয়ের শিকার দেশগুলোর মানুষদের আশ্রয় দেয়ার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বরং উচিত নরওয়ের মত দেশ থেকে অভিবাসীদের আনা।
ওয়াশিংটন পোস্ট প্রেসিডেন্টকে সরাসরি উদ্ধৃত করে বলছে, এর পর তিনি বলেছেন, “এই সব ‘শিটহোল’ দেশ থেকে কেন লোকজনকে আমাদের দেশে আনতে হবে।”
সেনেটর ডারবিন বলেন, যখন প্রেসিডেন্টকে জানানো হয় যে ‘টেম্পোরারি প্রটেকটেড স্ট্যাটাস’ (টিপিএস) বা সাময়িক সুরক্ষা পাওয়া অভিবাসীদের বেশিরভাগই এল সালভাডর, হন্ডুরাস এবং হেইতির নাগরিক, তখন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘হেইশিয়ান? আমাদের কি আসলে আরও হেইশিয়ানের কোন দরকার আছে”?
তবে শুক্রবার সকাল থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প একের পর এক টুইট করে এরকম কথা বলার কথা অস্বীকার করতে থাকেন। তিনি বলেন, “আমি হাইতির মানুষ সম্পর্কে বাজে কিছু বলিনি।”
বোতসোয়ানা সেদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, এসব কথাবার্তা চরম দায়িত্বহীন, নিন্দনীয় এবং বর্ণবাদী।”
আফ্রিকান ইউনিয়ন বলেছে, তারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মন্তব্য শুনে শঙ্কিত।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক মুখপাত্র রুপার্ট কোলভিল বলেছেন, যদি প্রেসিডেন্ট এসব কথা সত্যিই বলে থাকেন সেটা স্তম্ভিত হওয়ার মতো এবং লজ্জাজনক। তিনি বলেন, এটাকে ‘বর্ণবাদী’ বলা ছাড়া আর কিছু বলার সুযোগ নেই।
আর যুক্তরাষ্ট্রে অশ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের একটি সংগঠন ‘ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশেন ফর দ্য এডভান্সমেন্ট অব কালারড পিপল’ বলেছে, প্রেসিডেন্ট দিনে দিনে আরো বেশি করে বর্ণবাদ আর বিদেশি বিদ্বেষের গর্তের গভীরে ঢুকে যাচ্ছেন।
কংগ্রেসের এক কৃষ্ণাঙ্গ সদস্য সেডরিক রিচমন্ড বলেছেন, প্রেসিডেন্ট যে আমেরিকাকে আবারো সেরা দেশে পরিণত করার নামে আসলে শ্বেতাঙ্গদের দেশে পরিণত করতে চাইছেন, এটা তার আরো একটা প্রমাণ।