বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘মাননীয় আদালত আপনি জানেন, ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিনের অবৈধ সরকার মিথ্যা মামলায় আমাকে এবং আমার দুই ছেলেকে গ্রেপ্তার করেছিল। বন্দি অবস্থায় পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে তাদের হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। আমার বড় ছেলে তারেক রহমান সেই নির্যাতনে পঙ্গু হয়ে এখনো বিদেশে চিকিৎসাধীন। আমার ছোট ছেলেটি আর সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায়নি। বিদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই সে অকালে আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছে। সন্তানের অকাল মৃত্যুর সেই দুঃসহ ব্যথা বুকে চেপে আমি এখনো দেশের জন্য মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’
এই কথা বলে আদালতে কেঁদে ফেলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এ সময় তাঁকে বেশ কয়েকবার চোখ মুছতে দেখা যায়।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ ড. আখতারুজ্জামানের আদালতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টে দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের করা মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে তৃতীয় দিনের মতো দেওয়া বক্তব্যে এসব কথা বলেন খালেদা জিয়া। আদালতে প্রায় দেড় ঘণ্টা বক্তব্য দেন সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের অবৈধ সরকারের জুলুম-নির্যাতন ও স্বেচ্ছাচারী কার্যকলাপের কথা নিশ্চয়ই আপনি ভুলে যাননি। ব্যবসায়ীসহ যাকে-তাকে মিথ্যা অজুহাতে ধরে নিয়ে সে সময় তারা টাকা আদায় করত। রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকায় জমি-বাড়ি দখলের কাজেও তারা বিভিন্ন পক্ষে প্রভাব খাটিয়েছে। আইন-আদালত ও বিচার ব্যবস্থাকে তারা তাদের নির্দেশে চালিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক এবং সাংবাদিকদের ওপর তারা নির্যাতন করেছে। এত অপকর্ম করেও মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনরা বিদেশে আরাম-আয়েশে দিন কাটাচ্ছে। আজ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগও দায়ের করা হয়নি।’
বিএনপির চেয়ারপারসন আরো বলেন, ‘তাদের অন্যতম দোসর মাসুদউদ্দিন চৌধুরীকে দীর্ঘদিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে বহাল রেখে লালন-পালন করা হয়েছে। এ সবের কারণ, আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতায় এসেছিল। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা নিশ্চিত করা হয়েছিল। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করলেও মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের পক্ষে যখন আর ক্ষমতায় থাকার কোনো উপায় ছিল না, তখন তারা নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। কেননা আমাদের বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে দেশের ভেতরে ও বাইরের পরিস্থিতি অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। তারা আমার সঙ্গেও সমঝোতার চেষ্টা করেছে। নানা রকম প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে গেছে। আমি তাদের কোনো প্রস্তাবে রাজি হইনি। আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছি, অবৈধ শাসকদের সঙ্গে কোনো রকম সমঝোতা আমি করব না। জরুরি অবস্থা তুলে দিয়ে তাদের নির্বাচন দিয়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে আঁতাত করেই ক্ষমতায় গিয়েছিল। তারপরও আমরা সাংবিধানিক শাসন ও গণতন্ত্রের স্বার্থে ওই কারসাজির নির্বাচনের ফল মেনে নিয়েছিলাম। আমরা সরকারকে সহযোগিতা করার কথা বলেছিলাম। কিন্তু আমাদের সহযোগিতার আহ্বানের বিনিময়ে তারা আমাদের সঙ্গে কী আচরণ করেছে তা সকলেরই জানা।
প্রতিহিংসার বিপরীতে সংযম, সহিষ্ণুতা ও সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা আমি বরাবর করে এসেছি। কিছুদিন আগেও আমি একটি সংবাদ-সম্মেলন করে অতীতের সকল তিক্ততা ভুলে ক্ষমার কথা তুলে ধরি। আমি পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করি যে, আমার এবং শহীদ জিয়াউর রহমানসহ আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার ক্রমাগত অশোভন উক্তি এবং প্রতিহিংসামূলক বৈরী আচরণ স্বত্ত্বেও আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে ক্ষমা করে দিচ্ছি। আমি তার প্রতি কোনো প্রতিহিংসাপ্রবণ আচরণ করব না। আমি আহ্বান জানিয়েছিলাম, আসুন, রাজনীতিতে একটি সুন্দর, শোভন ও সহিষ্ণু সংস্কৃতি গড়ে তুলি। যা গণতন্ত্রের জন্য খুবই প্রয়োজন।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে আমাদের কাছ থেকে ভালো কিছু শিখতে পারে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমঝোতার পরিবেশ গড়তে আমাদের মরহুম জাতীয় নেতৃবৃন্দকে সম্মানিত করার ব্যাপারে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্যও আমি বিভিন্ন সময়ে প্রস্তাব দিয়েছি। এ ছাড়া বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজার ব্যাপারেও আমাদের প্রস্তাব সব সময় ছিল এবং এখনো আছে। ইতিমধ্যে আমি সমঝোতার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা, জনগণের ক্ষমতা তাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া, সামাজিক ইনসাফ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার রূপকল্প ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করেছি। কিন্তু এসব উদারতার জবাব আমাদের কোন ভাষায় দেওয়া হচ্ছে, তার প্রমাণ সকলেই পাচ্ছেন এবং আপনিও জানেন। তাদের কী অবস্থা? দেশে গণতন্ত্র নেই। কার্যকর সংসদ নেই। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে।’
খালেদা জিয়া বলেন, খুন, অপহরণ, গুম, নির্যাতন ও বিচারহীনতার এক স্বেচ্ছাচারী রাজত্ব চলছে। দেদার চলছে ক্ষমতার অপব্যবহার। কারাগারগুলো রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও ভিন্নমতের মানুষ দিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে। কথায় কথায় মামলা-হামলা, গ্রেপ্তার ও নির্যাতন চলছে। প্রতিবাদের কোনো সুযোগ নেই। টু-শব্দটি করলেই নির্যাতনের খড়গ নেমে আসছে। চলছে সন্ত্রাস, দখল ও দলীয়করণের বিভীষিকা। বয়োবৃদ্ধ মানুষদের পর্যন্ত দিনের পর দিন পুলিশী রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। সংবাদ-মাধ্যম শৃঙ্খলিত। সম্পাদক ও সাংবাদিকরা বন্দি হচ্ছে। ব্যাপকভাবে আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি নৃশংসভাবে খুন হলেও বিচার হচ্ছে না।
সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনে পরিস্থিতি সম্পর্কে নিয়মিত উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। নারী-শিশুরা নির্যাতিত ও নিহত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ব্লগার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও বিভিন্ন ধর্মের লোক, এমনকি বিদেশিরা খুন হচ্ছেন। সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হচ্ছেন, তাঁদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। কোথাও কারো কোনো নিরাপত্তা ও অধিকার নেই। অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে নির্বিচারে গুলি করে প্রতিবাদী মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে। ছাত্র ও শিক্ষকদের হত্যা করা হচ্ছে। এগুলো কি ক্ষমতার অপব্যবহার নয়? ক্ষমতার অপব্যবহার আমি করেছি? শেয়ার বাজার লুট করে লাখ হাজার কোটি টাকার তছরূপ হয়ে গেল। নিঃস্ব হলো নিম্ন আয়ের মানুষ। ব্যাংকগুলো লুটপাট করে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে।’
এরপর আদালতে খালেদা জিয়া আজকের মতো বক্তব্য শেষ করলে আদালত আগামী ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক হারুন-অর-রশিদ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক বাসুদেব রায়।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন—খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী (পলাতক), হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।
এ ছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলা করে দুদক।
২০১০ সালের ৫ আগস্ট খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন দুদকের উপপরিচালক হারুন আর রশিদ। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ খালেদা জিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক বাসুদেব রায়।
মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন—মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান।