Monday , 23 December 2024
সংবাদ শিরোনাম

সুরক্ষা আছে পরিবারেই

হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ বৃদ্ধি, বিশেষ করে একের পর এক শিশু-কিশোর খুন হওয়ার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কয়েকটি রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পারিবারিক, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকেই ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে নৈতিক অবক্ষয়ের ক্ষেত্র।

তথ্য-প্রযুক্তি, আকাশ সংস্কৃতি ও অতি-আধুনিকতায় আসক্তি বা এসবের অপপ্রয়োগ এই অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করছে। এ ছাড়া অর্থের লোভ, মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে উদাসীনতা, ধর্মীয় সংস্কারকে অবজ্ঞা করার মতো মানসিকতাও অনেক পরিবারকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে; পরিবারে ঘটছে হৃদয়বিদারক অপরাধমূলক ঘটনা। এর সঙ্গে ওথেলো সিনড্রোমের মতো মনোদৈহিক সমস্যাও জড়িত থাকে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসার ওপরও জোর দিচ্ছেন।

এক সপ্তাহ আগে রাজধানীতে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দুই জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে; নিহত চারজনের মধ্যে দুজনই ছিল অল্পবয়সী। একটি ঘটনায় মাকে হত্যা করতে এসে তাঁর ছেলেকেও খুন করা হয়, অন্যটিতে এক মেয়ে তার বাবার হত্যাকাণ্ড দেখে ফেলার মূল্য দেয় জীবন দিয়ে। গতকাল সোমবারও কালের কণ্ঠে প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদনে শিশু-কিশোরদের ওপর সহিংসতার ঘটনা জানা যায়। মানিকগঞ্জে ১৪ বছরের বৃষ্টি আক্তারকে জবাই করা হয়েছে বিয়েতে রাজি না হওয়ায়। টাকা চুরির অপবাদে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে এক শিশুর হাতের আঙুলে পিন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে জেএসসি পরীক্ষার্থী প্রিয়াংকার লাশ পাওয়া গেছে ড্রেনে।

পুলিশ অপহরণকারীদের ধরতে না পারলে তাদের হাতে হয়তো প্রাণ হারাত অপহৃত ছয় বছরের তাওসিফুরও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, রাষ্ট্র ও সমাজের দিক থেকে অনৈতিক সম্পর্কের ষয়ে অনেক ধরনের পদক্ষেপ রয়েছে। স্বামী বা স্ত্রীর অন্য কারো সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ককে পরকীয়া বলে অভিহিত করার মাধ্যমে সমাজ এই সম্পর্ককে প্রত্যাখ্যান বা নিন্দা জানিয়েছে। তার পরও যুগ যুগ ধরে এমন সম্পর্ক ঘটেই চলেছে। রাষ্ট্র আইনি কাঠামোতেও এমন সম্পর্ক সমর্থন করে না বরং অবৈধ হিসেবে ধার্য করেছে। সুতরাং পরিবার ও ব্যক্তির মূল্যবোধকেই এসব থেকে রক্ষায় সবার আগে জাগ্রত করতে হবে। তাঁর মতে, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে ব্যক্তি নিজে এবং পরিবার; তার পরের ভূমিকাটি সমাজের। তিনি আরো বলেন, ব্যক্তি ও পরিবারের সম্পর্কে ফাটল ধরলেই মনুষ্যত্ববোধের ঘাটতি তৈরি হয় এবং সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো এর প্রভাব মাত্র। ব্যক্তি মানুষের অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে পরিবারে তার বেড়ে ওঠার মতো কিছু বিষয় জড়িত বলে মত দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সালাহ উদ্দীন কাউসার বিপ্লব। তিনি বলেন, ‘মা-বাবা কিংবা পরিবারে ওই মূল্যবোধের অবস্থা সে কেমন দেখেছে, কেমন শিখেছে, পারিবারিক বন্ধন কেমন আছে, পরিবারের সদস্যদের আচরণ ও নীতি-নৈতিকতার অবস্থা কোন পর্যায়ে ছিল বা আছে তার সব কিছুই এর সঙ্গে যুক্ত। ’ মানুষের বিবেকহীন আচরণের পেছনে তার পারিবারিক, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ প্রভাব ফেলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একজন মানুষ যদি তার যাপিত জীবনের আওতায় ভালো-মন্দের পরিণতি বা প্রভাব নিয়ে ভাবার মতো মূল্যবোধ ধারণ করে বেড়ে ওঠে, তবে সে কখনো কোনো অপরাধে উদ্বুদ্ধ হতে পারে না। কারণ তার মনে সব সময় কোনো অপরাধের চিন্তা ঢুকতে গেলেই মূল্যবোধ বাধা হয়ে দাঁড়াবে। ’একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. সুলতানা আলগীন প্রায় একই কথা বললেও এর সঙ্গে তিনি তথ্য-প্রযুক্তির প্রভাবকেও যুক্ত করেন। ‘আমাদের দেশে নৈতিক মূল্যবোধ ধ্বংসের পেছনে এখন ফেসবুকসহ অনলাইনের অপপ্রয়োগের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এখনো এ প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি অনেকেই। অনেক ক্ষেত্রে কেউ কেউ নিজেকে সংযত রাখতে পারছে না। অনেকের পক্ষেই বন্ধুত্বের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে, যা রীতিমতো আসক্তিতে পরিণত হয়। এগুলোও এখন ঘরে ঘরে অশান্তির বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। ’ তাঁর মতে প্রযুক্তির ভালো-মন্দ দুই দিকই সবাইকে জানতে হবে এবং এই জানানোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোরও ভূমিকা রয়েছে। পরিবারের মধ্যেই পারস্পরিক বন্ধন, শৃঙ্খলা এবং নৈতিক বোধের চর্চা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, তা না হলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।

তবে সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাবকে খুব একটা জোরালোভাবে দায়ী করতে চান না। তাঁর যুক্তি হচ্ছে, যে যুগে আকাশ সংস্কৃতি ছিল না, তখনো হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ ঘটেছে। এখন মানুষ বেশি, মিডিয়া বেশি বলে ঘটনা বেশি মনে হচ্ছে আবার প্রচারও বেশি হচ্ছে। অধ্যাপক মনিরুলও এসব বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন।

বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, মানসিক সমস্যা বা মনোরোগ থেকেও সমাজে কেউ কেউ হত্যা বা শিশু হত্যার মতো অপরাধ সংঘটিত করতে পারে কিংবা সংসার বা পরিবারে অশান্তির কারণ হতে পারে। বাংলাদেশ সাইকিয়াট্রিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম গোলাম রব্বানী জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন সারা পৃথিবীতে তিন হাজার মানুষ আত্মহত্যা করছে। এর চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি লোক আত্মহত্যার চেষ্টা করছে, যাদের বেশির ভাগেরই কারণ অসম্পূর্ণ বা চিকিৎসাহীন বিষণ্নতা। তিনি হিসাব দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে আত্মহত্যার চেষ্টা করা মানুষের মধ্যে চার ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ২৫ শতাংশ ভুগছে বিষণ্নতায়। যাদের বেশির ভাগই কখনো চিকিৎসা পায়নি। অনেকে আত্মহত্যা না করে উল্টো অন্য কোনো আপনজনকে হত্যা করার মতো অপরাধেও লিপ্ত হয়ে থাকে। ডা. রব্বানী বলেন, অহেতুক ভীতি বা ফোবিয়া, জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিস-অর্ডার বা অত্যধিক দুশ্চিন্তাজনিত রোগ এবং কিছু ব্যক্তিত্ব-বৈকল্য বা পারসোনালিটি ডিস-অর্ডারে আক্রান্তদের মধ্যেও আত্মহত্যা বা আপনজনকে হত্যায় উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে।

ওথেলো সিনড্রোম : সংসারে অশান্তি বা সংসার ভাঙার পেছনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দায়ী করা হয়ে থাকে সন্দেহপ্রবণতাকে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের ভাষায় যা ‘ওথেলো সিনড্রোম’ বা সংসার ভাঙা রোগ। রোগটি পুরনো হলেও এ দেশে এই রোগের চিকিৎসা বা গবেষণা আগে তেমন ছিল না। তবে এখন এই রোগের ব্যাপারে অনেক কাজ হচ্ছে।

ঢাকা সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, রাজধানীতে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ হাজার সংসার ভেঙে যাচ্ছে ঢাকায়। এর ৭৫ শতাংশই স্ত্রীর পক্ষ থেকে তালাক দেওয়া হচ্ছে। এর পেছনেও ওই ওথেলো সিনড্রোমের প্রভাব রয়েছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top