নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রস্তাব বা রূপরেখা শিগগিরই দিচ্ছে না বিএনপি। দলটি মনে করছে, নির্বাচনের আগে ওই প্রস্তাবই হচ্ছে বিএনপির সর্বশেষ ট্রাম্প কার্ড; যার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তথা সরকারের মনোভাবের ওপর নির্ভর করবে দলটির নির্বাচনপূর্ব রাজনীতির কৌশল।
বিশেষ করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রয়োজন হবে কি না, তা নির্ভর করছে ওই প্রস্তাবের ওপর।
ফলে এমন একটি সময়ে বিএনপি ওই প্রস্তাব উত্থাপন করতে চায়, যাতে আন্দোলন শুরু হলে তা নির্বাচন পর্যন্ত টেনে নেওয়া যায়।
সংবিধান অনুযায়ী একাদশ সংসদ নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে। সে অনুযায়ী নির্বাচনের দিনক্ষণ এখনো বেশ দূরে। কিন্তু এখনই সহায়ক সরকারের প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে নির্বাচনের আগে জনগণ তা ভুলে যাবে বলে মনে করে বিএনপি। দলটির নেতাদের মতে, তখন আর ওই ইস্যুতে আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব না-ও হতে পারে। তা ছাড়া ওই ইস্যুতে এখনই জনমত গঠন করা হলে তা এত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ধরে রাখাও কঠিন বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা। ফলে তাঁদের ভাষায়, ‘সাসটেইন’ করা যাবে এমন সময়ই ওই প্রস্তাব উত্থাপন করতে হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, উপযুক্ত সময়ে সহায়ক সরকারের প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে।
এটি নিয়ে বিএনপির কোনো তাড়াহুড়া নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ওই প্রস্তাব এখনো চূড়ান্তও হয়নি। তা ছাড়া ওই প্রস্তাবের ওপর এ দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপথও অনেকাংশে নির্ভরশীল।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদও বলেন, ‘সহায়ক সরকার নিয়ে বিএনপিতে কোনো তাড়াহুড়া নেই। এখন প্রস্তাব দিলে দু-এক সপ্তাহ পরে মানুষ এটি ভুলে যাবে। প্রস্তাব দেওয়ার পর ওই ইস্যুতে আমরা সাসটেইন করতে চাই। এর ফলোআপ করতে হবে। ’ প্রস্তাব নির্বাচনকালের সঙ্গে সম্পর্কিত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সময় ও সুযোগ বুঝে এটি উপস্থাপন করা হবে। প্রস্তাবকে ‘একটি সিরিয়াস ম্যাটার’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটি একটি বক্তৃতা নয় যে দিয়ে ফেললাম আর শেষ হয়ে গেল। ’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে জানান, নির্বাচনের দিনক্ষণ তথা বিএনপির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করে সহায়ক সরকারের প্রস্তাব জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সহায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন হবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জানান, প্রস্তাবের খসড়া প্রস্তুত আছে। কিন্তু এটি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এ প্রস্তাবের সঙ্গে ‘অনেক কিছু’ সম্পর্কিত।
বেশ কয়েক মাস ধরেই সহায়ক সরকারের প্রস্তাব নিয়ে কাজ চলছে বিএনপিতে। দলটির নীতিনির্ধারকদের গাইডলাইন অনুযায়ী বিএনপি সমর্থক এক দল বুদ্ধিজীবী প্রস্তাবটির খসড়া তৈরি করছেন। ওই খসড়া প্রস্তুত হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তা আলোচনা করে চূড়ান্ত হবে। এরপর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জনগণের সামনে প্রস্তাব উত্থাপন করবেন দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
সূত্র মতে, প্রস্তাব উত্থাপনের পর বিভিন্ন মহলে প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি সরকারি দলের মনোভাব স্পষ্ট হবে। সরকারি দল ‘এককথায়’ বা সরাসরি ওই প্রস্তাব প্রত্যখ্যান করলে বিএনপি প্রথমে প্রস্তাবের পক্ষে জনমত গঠনের উদ্যোগ নেবে। এরপর সভা-সেমিনার করার পাশাপাশি গণমুখী বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে। কিন্তু সরকার কোনো সাড়া না দিলে শেষ পর্যন্ত দলটি আন্দোলনের পথেই হাঁটবে বলে জানা গেছে।
বিএনপিপন্থী বলে পরিচিত সুধীসমাজের প্রতিনিধি শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের মতে, সহায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে নামেই হোক, ওই প্রস্তাব এখনই উত্থাপন করা হলে তা থেকে কার্যকর কোনো ফল পাওয়া যাবে না। কারণ মানুষের মন থেকে তা হারিয়ে যাবে। এর বদলে আগামী বছরের মাঝামাঝি বা শেষ সময়ে ওই প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে ভালো। তিনি বলেন, সহায়ক সরকারের রূপরেখা হচ্ছে বিএনপির সর্বশেষ কার্ড, যা উপযুক্ত সময়ে ব্যবহার করতে হবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীনের মতে, সহায়ক সরকার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা নির্বাচনকালীন সরকার যেকোনো নামে রূপরেখা দেওয়া যায়। কারণ এর অর্থ বা কাঠামো একই হবে। তবে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা উঠে যাওয়ায় ওই নাম দেওয়ার আর যুক্তি নেই।