সপ্তাহ ধরেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মিদের মধ্যে চলা গোলাগুলি সোমবার (২৯ জানুয়ারি) ও মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্ধ ছিল। তবে মঙ্গলবার রাত থেকে তা আবারও শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় একটি মর্টার শেল বান্দরবান সীমান্তে এসে পড়েছে।
বুধবার (৩১ জানুয়ারি) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম কুলাল পাড়া এলাকায় মর্টার শেলটি এসে পড়ে। তবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়ায় রোহিঙ্গাসহ সীমান্তের বাসিন্দারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আজিজ এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন ।
এদিকে মর্টার শেল পড়ার ঘটনায় বান্দরবান জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করছেন।
স্থানীয়রা জানান, গোলাগুলির শব্দ শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে তারা। কিন্তু গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়ায় জীবন ও যানমালের নিরাপত্তায় আতঙ্কিত সীমান্ত এলাকার মানুষ।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরের ঘটনাগুলো তাদের বিষয়। তবে আমাদের দেশের নিরাপত্তাসহ যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সচেষ্ট রয়েছে প্রশাসন। সীমান্তে বিজিবির টহলও জোরদার করা হয়েছে। তাই আতঙ্কতি না হওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।
স্থানীয়দের তথ্য মতে, আরাকান রাজ্যের দখল নিয়ে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠি আরাকান ও জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি চলছে। ইতোমধ্যে আরাকান রাজ্যের অনেকাংশ দখল করে নেওয়ার দাবিও করেছে আরাকান আর্মি।
দখল ও দখল উদ্ধার নিয়ে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। আরকান রাজ্যে শুরু হওয়া এই সংঘাত আগে সকাল-সন্ধ্যা কিংবা রাতে চললেও এখন বেশিরভাগ সময় রাতেই বেশি হচ্ছে। বিশেষ করে আরকান রাজ্যের পশ্চিম, পূর্ব এলাকায় এ সংঘর্ষ চলছে। গোলাগুলির ঘটনায় কি পরিমাণ হতাহত হচ্ছে তা জানা না গেলেও এ সংখ্যা অনেক বলে ধারণা করছেন তারা।
তাদের দাবি, মিয়ানমারে গোলাগুলির ঘটনা নতুন কিছু নয়। সীমান্তের লোকজন এসব শুনে অভ্যস্ত। তবে সম্প্রতি সংঘাতের ঘটনায় মিয়ানমারের ছোঁড়া গুলি ও মর্টার শেল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে পড়ায় আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন তারা। বুধবার ভোরে বেশ কিছু গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়েছে ধুমধুমের তুমব্রু সীমান্তে।
তুমব্রু সীমান্তের স্থায়ী বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মিয়ানমারে প্রতিনিয়ত গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই আমরা। এটি নতুন কিছুই নয়। তবে ই্উনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের কুলালপাড়া এলাকায় গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়ায় লোকজন আতংকিত হয়ে পড়ছে।
২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য দিল মোহাম্মদ ভূট্টো বলেন, মানুষের মাঝে কিছুটা আতংক ছড়ালেও সীমান্ত থেকে স্থানীয়দের সড়ানোর কোনো নির্দেশনা প্রশাসন থেকে আমরা পাইনি। এছাড়া বন্ধ থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও খুলে দেওয়া হয়েছে।
বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপার পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে উত্তেজনা চলছে। এ অবস্থায় ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে যেন অনুপ্রবেশ না ঘটতে পারে কিংবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেন অবনতি না হয় সেজন্য জেলা পুলিশ সচেষ্ট রয়েছে।
আমরা ঘুমধুম এলাকায় সাধারণ মানুষ-জনপ্রতিনিধি এবং বিজিবির সাথে কথা বলেছি। ইতিমধ্যে সীমান্ত এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। এককথায় ঘুমধুম এলাকায় আইন শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে বন্দরবান জেলা পুলিশ।
এদিকে টেকনাফের উলুবনিয়ায় গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়ার পর থেকে ভয়ে আতংকে দিন কাটাচ্ছে স্থানীয়রা। নাফ নদীতে মাছ ধরা কিংবা চিংড়ি ঘেরে মাছের পরিচর্যা করতে ভয় পাচ্ছেন তারা।
তাদের অভিযোগ, সীমান্তের মানুষের মনে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা্, ভয় ও আতংক দেখা দিলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো কথা জানানো হচ্ছেনা। ফলে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন তারা।
তাদের দেওয়া তথ্য মতে, মিয়ানমারের পাশ্চিমাংশের কোয়াংচিবং এলাকা, নাইচদং, লারগাপাড়া, মেদিপাড়া, জুম্মাকাটা, জুট্টখালী, গোদলাবাজার, কুমিরখালী, ঘুমরি পাড়া এলাকা থেকে বুধাবারও গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেয়েছেন তারা।
টেকনাফ হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের ১ নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য জালাল আহম্মদ বলেন, ২৫-২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক ছিল। উলুবনিয়া এলাকায় এক ব্যক্তির বাড়িতে গুলি এসে পড়ার পর থেকে আতংক ছড়িয়ে পড়ে স্থানীয়দের মাঝে।
ইতিমধ্যে অনেক বাসিন্দা বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও মহিলারা এলাকা ছেড়েছে। এখন এলাকার বাসিন্দারা অনেকটা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। বিনা প্রয়োজনে ঘরের বাইরেও যাচ্ছে না। চিংড়ি চাষিরা ভয়ে ঘেরে যেতে পারছে না। ফলে ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন তারা।
পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে অস্থিরতা তৈরি হলে সে দেশের বাসিন্দারা আবারো আমার দেশের দিকে চলে আসতে পারে। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে।
এদিকে সীমান্তে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিজিবির সতর্ক অবস্থানের কথা জানিয়েছেন ৩৪ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, সীমান্তে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছি আমরা। আতংকিত হওয়ার কিছু নেই।