চলতি বছরের শুরু থেকে কয়েক দফা দামের উত্থান-পতনের পর শেষমেশ আবারও দেশের বাজারে সোনার ভরি লাখ টাকা ছাড়াল। আর এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুই দফা সোনার দাম বাড়িয়েছে জুয়েলার্স সমিতি। আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও দেশে বাড়ানো হয়েছে সোনার দাম। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে প্রতি ভরিতে সোনার দাম বেড়েছে ৩০ হাজার টাকার চেয়েও বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশে নির্ধারিত দর সোনার বৈশ্বিক দরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সোনার দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা দরকার। এদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের সোনার দাম অনেকটা লাগামছাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। গত তিন বছরে বাংলাদেশে সোনার দাম বেড়েছে ৪৩ শতাংশ।
অন্যদিকে ভারতে দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ দেশে এক সপ্তাহের ব্যবধানে সোনার দাম বেড়েছে। এতে সোনার ভরিপ্রতি দাম আবার লাখ টাকা ছাড়াল। এবার ভালো মানের সোনা অর্থাৎ হলমার্ক করা ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনা বিক্রি হবে ১ লাখ ১ হাজার ২৪৪ টাকা। এটিই এখন পর্যন্ত দেশের বাজারে সোনার সর্বোচ্চ দাম। গতকাল শুক্রবার থেকে সারা দেশে সোনার নতুন এ দর কার্যকর হয়।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সোনার মূল্যবৃদ্ধির তথ্য জানায়। এতে বলা হয়, স্থানীয় বাজারে পাকা সোনার দাম বেড়েছে। সে কারণে সোনার দাম সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সমিতি।
এদিকে সোনার এত দামের কারণ প্রসঙ্গে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতি আর ‘অকার্যকর আমদানি নীতির কারণেই সোনার দাম বেড়েই চলেছে, যা কমার লক্ষণ খুব একটা নেই বলেই মনে করেন তারা। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি দাম বৃদ্ধিতে ভ‚মিকা রাখলেও এত দাম হওয়া উচিত নয়। বরং সোনার যথাযথ বাজার মেকানিজম না থাকাকেই দাম অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ার জন্য দায়ী বলে মনে করেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা বলেন, বাংলাদেশে সোনার দামের ক্ষেত্রে উল্লম্ফন ঘটেছে কিন্তু এই উল্লম্ফনের কোনো ‘যৌক্তিক ও সুনির্দিষ্ট’ কারণ নেই। যদিও চলতি বছরের শুরুতেই বিশেষজ্ঞরা আভাস দিয়েছিলেন যে এ বছর সোনার দাম অনেক বেড়ে যেতে পারে। বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারিতে বাংলাদেশে প্রতি ভরি সোনার দাম ছিলো ৯৩ হাজার ৪২৯ টাকা। জুলাইতে এসে এই দাম এক লাখ অতিক্রম করল।
বাজুসের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়াল বলছেন, রাশিয়া সোনার উৎপাদনকারী বড় দেশ এবং যুদ্ধের জের ধরে কয়েক বছর ধরে নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার সোনার বাজারে আসছে না। হঠাৎ করে কাল যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলে হয়তো দাম কমতে পারে। এছাড়া ডলারের বিনিময় হার, ক্রুড ওয়েলের দামসহ আনুষঙ্গিক বিষয় বিবেচনা নিলে বলতে হয় দাম কমার আপাতত কোনো লক্ষণ আমরা দেখছি না।
বাজুসের সাবেক প্রেসিডেন্ট এনামুল হক খান বলছেন, বাংলাদেশে মাঝে প্রায় দুই দশক সোনার দাম স্থিতিশীল ছিল। তখন যদি নিয়মিত দাম সমন্বয় হতো তাহলে এখন দাম এত বেশি মনে হতো না। যদিও সায়মা হক বিদিশা বলছেন সরকার বৈধভাবে সোনা আনা ও ব্যবসার সুযোগ দিলেও বাজারে তার প্রভাব পড়েনি অর্থাৎ এর সুফল ভোক্তারা পাচ্ছে না।
গত ২১ জুলাই দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সোনার দাম এক লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। তখন প্রতি ভরি সোনার দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ৭৭৭ টাকা। এরপর ১৭ আগস্ট তা কমে হয় ৯৯ হাজার ২৭ টাকা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম আবার বাড়িয়েছে জুয়েলার্স সমিতি। যদিও চলতি বছরের শুরুতে সোনার ভরি ৯০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। গত ১৯ মার্চ সোনার ভরিপ্রতি দাম এক লাফে ৭ হাজার ৬৯৮ টাকা বাড়ানো হয়। তখন সোনার ভরি ৯৮ হাজার ৭৯৪ টাকায় পৌঁছায়। তারপর কয়েক দফা দামের উত্থান-পতনের পর শেষমেশ প্রথমবারের মতো দেশের বাজারে সোনার ভরি এক লাখ টাকা ছাড়ায়।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল শুক্রবার থেকে ভালো মানের সোনার দাম ভরিতে ২ হাজার ২১৭ টাকা বাড়ছে। এতে হলমার্ক করা ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম হবে ১ লাখ ১ হাজার ২৪৪ টাকা। এ ছাড়া হলমার্ক করা প্রতি ভরি ২১ ক্যারেট সোনা ৯৬ হাজার ৬৩৬ টাকা, ১৮ ক্যারেট ৮২ হাজার ৮১৪ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির সোনা ৬৯ হাজার ৫১ টাকায় বিক্রি হবে। এর মধ্যে ২১ ক্যারেটে সোনার প্রতি ভরিতে ২ হাজার ৪১ টাকা, ১৮ ক্যারেটে ১ হাজার ৭৪৯ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির সোনায় ১ হাজার ৫১৬ টাকা বেড়েছে।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত হলমার্ক করা প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট সোনা ৯৯ হাজার ২৭ টাকা, ২১ ক্যারেট ৯৪ হাজার ৫৯৫ টাকা, ১৮ ক্যারেট ৮১ হাজার ৬৫ টাকা ও সনাতন পদ্ধতির সোনা ৬৭ হাজার ৫৩৫ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে। অন্যদিকে রুপার দাম অপরিবর্তিত থাকছে। হলমার্ক করা প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট রুপার দাম এখন ১ হাজার ৭১৫ টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সোনার দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা দরকার। দাম বাড়ানোর বিষয়ে বাজুসের নেতারা যুক্তি দিচ্ছেন, শুল্ক-কর বৃদ্ধি ও পরিমাণ আগের চেয়ে কমিয়ে দেয়ায় ব্যাগেজ রুলসের আওতায় বিদেশ থেকে সোনা নিয়ে আসা কমেছে। পুরনো অলঙ্কার বিক্রি করতে আসা গ্রাহকের সংখ্যাও তুলনামূলক কম। ফলে স্থানীয় বুলিয়ন বাজারে বিশুদ্ধ সোনার (পিওর গোল্ড) দাম বেড়েছে। এর ভিত্তিতে দাম সমন্বয় করা হয়েছে।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমূল্যের কারণে সোনার অলঙ্কার সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও হারিয়ে যাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে সোনার দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা দরকার। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারে সোনার দামের ফারাক কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। ফলে দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়ার পাশাপাশি যেসব তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো সঠিক কি না, তা খতিয়ে দেখতে পারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তর।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সহ-সভাপতি দেয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, এর আগে স্থানীয় বুলিয়ন মার্কেটে প্রতি ভরি পিওর গোল্ডের (বিশুদ্ধ সোনা) দাম ৯০ হাজার টাকায় উঠেছে। এই হিসাবে আমাদের দাম আরও বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল।’ তাই দাম বাড়ানো হয়েছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, জুয়েলার্স সমিতি অলিখিতভাবে সোনার বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তারাই দাম নির্ধারণ করে। কিন্তু দেশে নির্ধারিত দর সোনার বৈশ্বিক দরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
দেশে সোনার দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে প্রতি ভরি সোনার দাম বেড়েছে ৩০ হাজার টাকার চেয়ে বেশি। প্রতি ভরি সোনার দাম এখন লাখ টাকা ছাড়িয়েছে, যা তিন বছর আগেও ছিল ৭০ হাজার টাকার কম। শুক্রবার থেকে কার্যকর হয়েছে সোনার দাম যেখানে ভালো কোয়ালিটির সোনা বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ১ হাজার ২৪৪ টাকা। দেশে সোনার দাম বাড়ানো কিংবা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি বা বাজুস। গত মার্চেই তারা দাম প্রায় সাড়ে সাত হাজার টাকা বাড়িয়েছিল। এরপর সাতই জুন বাড়িয়েছিল আরও প্রায় দুই হাজার টাকা। মাঝে অল্প কিছু কমে আবার বেড়ে সর্বশেষ দাম ছিল ৯৮ হাজার ৪৪৪ টাকা ছিল।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের সোনার দাম অনেকটা লাগামছাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। গত তিন বছরে বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। অন্যদিকে ভারতে দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ। ভারতের গত তিন বছরে ভরি প্রতি সোনার দাম প্রায় আট হাজার রুপি বাড়লেও বাংলাদেশে বেড়েছে ত্রিশ হাজার টাকার বেশি। তিন বছর আগে ভারতের একই পরিমাণ ২২ ক্যারেট সোনার দাম ছিল ৪৮ হাজার ৯০৬ টাকা আর ২৪ ক্যারেট ছিল ৫২ হাজার ৫১৫ টাকা। আর তিন বছর আগে অর্থাৎ ২০২০ সালে বাংলাদেশের সোনার ভরি ছিল ৭০ হাজার টাকার সামান্য কম।
এর আগে করোনা ভাইরাসের কারণে গত ২০২০ সালের মার্চ থেকে প্রায় দুই বছর সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ ছিল। তখন সোনার দাম নাগালের বাইরে চলে যায়। ফলে সোনার গহনা বানাতে দোকানমুখী ছিলেন না ক্রেতারা। আর তখন কাজ কমে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছিলেন গহনা তৈরির অধিকাংশ কারিগর। তাই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে কর্মী ছাঁটাই ও বেতন কমানোর পথে তখন হাঁটছিলেন জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা।
জানা যায়, দেশে বছরে ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার কেজি সোনার চাহিদা রয়েছে। তার মধ্যে ১০ শতাংশ পুরনো সোনার অলঙ্কার গলিয়ে সংগ্রহ করা হয়। এত দিন বৈধভাবে আমদানির সুযোগ না থাকায় চাহিদার বাকি ৯০ শতাংশ সোনা ব্যাগেজ রুলসের মাধ্যমে আসত। কারোনাকালীন সময়ে দেশে দেশে অবরুদ্ধ অবস্থা থাকায় বিমান চলাচল বন্ধ ছিল। এতে ব্যাগেজ রুলসের আওতায় বিদেশ থেকে সোনার বার আসা বলতে গেলে শূন্যের কোঠায় নেমে যায়।