মাহে রমজান মুমিন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। এ মাস রহমতের মাস, মাগফেরাতের মাস, নাজাতের মাস। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, রমজান এমন এক মাস, যার শুরুতে রহমত, মাঝে মাগফেরাত এবং শেষে রয়েছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি। (ইবনে খুজাইমা: ১৮৮৭)। অর্থাৎ রমজান মাসের ৩০ দিনের প্রথম ১০ দিন রহমতের, দ্বিতীয় ১০ দিন মাগফিরাতের এবং তৃতীয় ১০ দিন নাজাতের।
এ হাদিসের মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ (স.) উম্মতকে এই বার্তা দিয়েছেন যে, রমজান পুরোটাই বরকত আর বরকত। এই মাসে অতীতের সব পাপ ক্ষমা করিয়ে নেওয়ার অবারিত সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগ লুফে নিতে হবে। এরপর নাজাতের জন্য রমজানের শেষ পর্যন্ত সিয়াম সাধনা করে যেতে হবে। শুরু হয়েছে মাগফেরাতের দশক। এই দশকে ফরজ আমলের পাশাপাশি বিশেষভাবে যে পাঁচটি আমল গুরুত্বের সঙ্গে করবেন, সেগুলো হলো—
১) তাওবা-ইস্তেগফার
মাগফেরাতের দশকে আল্লাহর কাছে প্রত্যেক মুমিনের বেশি বেশি তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। কারণ তওবা-ইস্তেগফার সফলতার চাবিকাঠি। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা সবাই তওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’ (সুরা নুর: ৩১)
আনাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক আদম সন্তানই গুনাহগার। আর গুনাহগারদের মধ্যে তওবাকারীরা উত্তম’ (ইবনে মাজাহ: ৪২৫১)। অন্য আরেকটি হাদিসে গুনাহগার তওবাকারী ব্যক্তিকে নিষ্পাপ মানুষের সমান্তরালে দাঁড় করানো হয়েছে। আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) বলেন, মহানবী (স.) বলেছেন, ‘গুনাহ থেকে তওবাকারী নিষ্পাপ ব্যক্তিতুল্য।’ (ইবনে মাজা: ৪২৫০)
আল্লাহ তাআলা এই মাসে গুনাহ মাফের ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাই বান্দার উচিত এই মাসে বেশি বেশি তাওবা করা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন, যখন রমজান মাসের প্রথম রাতের আগমন ঘটে তখন দুষ্ট জিন ও শয়তানদের বন্দি করা হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, তার একটি দরজাও খোলা হয় না এবং জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, তার একটি দরজাও বন্ধ করা হয় না। আর একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকে— হে কল্যাণের প্রত্যাশী! অগ্রসর হও, হে অকল্যাণের প্রার্থী! থেমে যাও। আর আল্লাহ তাআলা এ মাসের প্রতি রাতে অসংখ্য জাহান্নামিকে মুক্তি দান করেন। (সুনানে তিরমিজি: ৬৮২)
তওবাকারীদের সফল আখ্যায়িত করে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ (সুরা নুর: ৩১)
২) তারাবি ও তাহাজ্জুদ আদায় করা
মাগফিরাত লাভে প্রত্যাশী মুমিন বান্দার উচিত, মাগফেরাতের দশকে তারাবি নামাজ যথাযথ আদায় করে চোখের পানি ফেলে আল্লাহর কাছে রোনাজারি করা। তারাবি হলো রমজানের বিশেষ ইবাদত। ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের উদ্দেশ্যে রমজান মাসে তারাবির নামাজ পড়বে, তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি: ৩৬, খণ্ড ১)
এছাড়াও তাহাজ্জুদের সময়ে প্রতি রাতেই আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে এসে বান্দাদের ফরিয়াদ শোনেন। হাদিসে এসেছে— ‘আল্লাহ তাআলা প্রতিদিন রাতের শেষ তৃতীয়াংশে নিচের আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, কে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব! কে আমার কাছে কিছু চাইবে, আমি তাকে দান করব! আর কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করব!’ (সহিহ বুখারি: ১১৪৫, মুসলিম: ৭৫৮)
৩) রোজাদারকে ইফতার করানো
মাগফেরাতের দশকে অসহায় ব্যক্তিদেরকে ইফতার করানোর মাধ্যমে গোনাহ মাফের চেষ্টা করা উচিত। ইফতার করানোর সওয়াব সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে; রোজাদারের সওয়াব থেকে একটুও কমানো হবে না।’ (তিরমিজি: ৮০৭; ইবনে মাজাহ: ১৭৪৬; ইবনে হিব্বান: ৮/২১৬; সহিহ আল-জামে: ৬৪১৫)
মানুষকে খাওয়ানো ভালোবাসার মাধ্যম। ভালোবাসা ছাড়া ঈমান হয় না। হাদিসের বর্ণনামতে, ‘তোমরা ঈমান আনা ছাড়া জান্নাত প্রবেশ করতে পারবে না। আর পারস্পারিক ভালোবাসা ছাড়া তোমাদের ঈমান হবে না।’ (সহিহ মুসলিম: ৫৪)
৪) দান সদকা
পবিত্র রমজানে দান-সদকার সওয়াব ও মর্যাদা অন্য মাসের তুলনায় অনেকগুণ বেশি। মানবতার আদর্শ মুহাম্মদ (স.) এর জীবনের মহিমান্বিত অভ্যাস ছিল উদারচিত্তে দান করা। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) ছিলেন মানুষের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। রমজানে তার দানশীলতা (অন্য সময় থেকে) অধিকতর বৃদ্ধি পেত..।’ (বুখারি: ০৬; মুসলিম: ২৩০৮; মুসনাদে আহমদ: ২৬১৬) রাসুলুল্লাহ (স.) আরও ইরশাদ করেছেন, যারা গোপনে দান করবেন মহান আল্লাহ কঠিন কেয়ামতের দিন তাদের আরশের ছায়াতলে স্থান দেবেন। (বুখারি: ৬৬০)
৫) দোয়া পাঠ
মাগফেরাতের দশকে কোরআনে বর্ণিত গুনাহ মাফের দোয়াগুলো বেশি পরিমাণে করা উচিত। যেমন এই দোয়াটি মাগফেরাতের দশকে সর্বাবস্থায় পাঠ করা উচিত اَسْتَغْفِرُ اللهَ رَبِّىْ مِنْ كُلِّ ذَنْبٍ وَ اَتُوْبُ اِلَيْهِ উচ্চারণ: ‘আসতাগফিরুল্লাহ রব্বি মিন কুল্লি যামবিন ওয়াতুবু ইলাইহি।’ অর্থ: ‘আমি আমার প্রভু আল্লাহর কাছে আমার সমুদয় পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তারই দিকে প্রত্যাবর্তন করছি।’ এছাড়াও নিচের দোয়াগুলো যত বেশি পড়া যায় ততই ভালো।
১) رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ উচ্চারণ: ‘রাব্বানা যালামনা আনফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফির লানা ওয়া তারহামনা লানাকুনান্না মিনাল খাসিরিন।’ অর্থ: ‘হে আমাদের প্রভু-প্রতিপালক! নিশ্চয় আমরা আমাদের প্রাণের ওপর অত্যাচার করেছি আর তুমি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না কর ও আমাদের প্রতি কৃপা না কর তাহলে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।’ (সুরা আরাফ: ২৩)
২) لَئِن لَّمْ يَرْحَمْنَا رَبُّنَا وَيَغْفِرْ لَنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ উচ্চারণ: ‘লা ইল্লাম ইয়ারহামনা রাব্বুনা ওয়া ইয়াগফির লানা লানাকুনান্না মিনাল খাসিরিন।’ অর্থ: ‘আমাদের প্রতিপালক! আমাদের ওপর যদি কৃপা না করেন এবং আমাদের ক্ষমা না করেন তাহলে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’ (সুরা আরাফ: ১৪৯)
৩) رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذا بَاطِلاً سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ উচ্চারণ: ‘রাব্বানা মা খালাকতা হাজা বাতিলাং সুবহানাকা ফাকিনা আজাবান নার।’ অর্থ: ‘হে আমাদের প্রভু! তুমি এ বিশ্বজগতকে বৃথা সৃষ্টি করনি। তুমি পবিত্র। সুতরাং তুমি আমাদের আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা কর।’ (সুরা ইমরান: আয়াত ১৯১)
৪) سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ উচ্চারণ: ‘সামি’না ওয়া আতানা গুফরানাকা রাব্বানা ওয়া ইলাইকাল মাসির।’ অর্থ: ‘আমরা (আল্লাহ তাআলার আদেশ) শুনলাম ও মানলাম, হে আমাদের প্রভু-প্রতিপালক! আমরা তোমারই কাছে ক্ষমা চাই আর তোমারই দিকে সবার ফিরে যেতে হবে।’ (সুরা বাকারা: ২৮৫)
সুতরাং মাগফেরাতের দশকে আল্লাহর কাছে তাওবা-ইস্তেগফারের পাশাপাশি তারাবি-তাহাজ্জুদ, মানুষকে খাওয়ানো, দান-সদকা ও দোয়া করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।