Monday , 23 December 2024
সংবাদ শিরোনাম

আমিরাতে ভ্রমণ ভিসায় লাখো তরুণ ইউরোপের স্বপ্নভঙ্গ, রাত কাটে পার্কে।

রাতের শহর দুবাই। সন্ধ্যা নামলেই শহরটির পাবলিক পার্ক কিংবা খোলা জায়গায় বাড়ে মানুষের ভিড়। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত; এমনকি ভোর পর্যন্ত পার্কে বসেই চলে আড্ডা। মতিনা পার্ক, ইউনিয়ন মেট্রো সংলগ্ন পার্ক, ক্রিক নদীর পাড়ে তারা জমায়েত হন। ভারতীয় ও পাকিস্তানিদের চেয়ে এসব স্থানে বাংলাদেশির ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতো। শুয়ে-বসে তারা সময় কাটান। দূর থেকে দেখলে মনে হবে তারা রাজ্যের সব সুখ নিয়ে জীবনযাপন করছেন। কাছে গেলেই শোনা যায় তাদের ভিন্ন গল্প। অধিকাংশই ভ্রমণ ভিসায় দুবাইয়ে এসেছেন। রুম ভাড়ার টাকা না থাকায় পাবলিক পার্কে সময় কাটাতে হচ্ছে। কেউ কেউ ১২ ঘণ্টা সময়ের ব্যবধানে ‘বেড শেয়ার’ করায় নিজের সময় আসা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। দালালের খপ্পরে পড়া এসব বাংলাদেশির কেউ কেউ আবার খোলা আকাশের নিচে শুয়েই ইউরোপ পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন। এ যেন এক অনিশ্চয়তার জীবন!

শরীয়তপুরের তানভীর ইসলাম এক মাসের ভ্রমণ ভিসায় আসেন সংযুক্ত আরব আমিরাত। ভিসা পেতে তাকে দালালকে দিতে হয় তিন লাখ টাকা। কথা ছিল- দেশটিতে পা রাখলে দ্রুত ‘ওয়ার্ক পারমিট’ বা কাজের ভিসা পাবেন। কিন্তু দুবাই আসার পর এক বছরেও মেলেনি কাজের ভিসা। শেষ হয়ে গেছে ভ্রমণ ভিসার মেয়াদ। মাথার ওপর এখন মোটা অঙ্কের জরিমানা নিয়ে ঘুরছেন শারজাহ প্রবাসী এই তরুণ। তানভীরের মতো সিলেটের।

বিয়ানীবাজারের জাহেদ বিন মাহমুদ চার মাস হলো ভ্রমণ ভিসায় এসেছেন। ভিসা বাবদ তিনিও তিন লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। কাজের জন্য ঘুরতে ঘুরতে শেষ হয়ে যায় তার ভিসার মেয়াদ। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিদিন তারও জরিমানা বাড়ছে। আরব আমিরাতের আইন অনুযায়ী ভ্রমণ ভিসার মেয়াদ শেষ হলে প্রথম দিন পাঁচ হাজার এবং এরপর প্রতিদিন দুই হাজার পাঁচশ টাকা করে জরিমানা হতে থাকে। সেই হিসাবে প্রতিদিন বাড়ছে তাদের জরিমানার পরিমাণ।

তানভীর ও জাহেদের মতো গেল দুই বছরে ভ্রমণ ভিসায় দুবাই এসেছেন কয়েক লাখ তরুণ। দালালের মাধ্যমে কাজ পাওয়ার প্রলোভনে তারা আসেন। অনেকে আবার ইউরোপ পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশে ভ্রমণ ভিসা নিয়ে আসেন। কেউ কেউ সফল হচ্ছেন। কেউ বা বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। অবৈধ পথে ইউরোপ-যাত্রায় কারও কারও জীবন প্রদীপও নিভে যাচ্ছে। জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর প্রশিক্ষণ কিংবা স্মার্টকার্ড না করায় সরকারি নথিপত্রে তাদের সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে দূতাবাস ও সরকারি উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা বলছেন, প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশির নতুন করে কর্মসংস্থান হয়েছে দেশটিতে। প্রতিনিয়ত ভ্রমণের এই ভিসা নিয়ে যে পরিমাণ বাংলাদেশি দেশটিতে প্রবেশ করছেন আদৌ তারা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছেন কিনা জানতে অনুসন্ধান করে সাংবাদিক নূরে আলম পারভেজ। এতেই বেরিয়ে আসে বাস্তব চিত্র।

প্রবাসীরা বলছেন, ভ্রমণ ভিসাধারীরা কর্মসংস্থানের জন্য দুবাইকে কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহার করছেন। ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার ভ্রমণ ভিসা তারা কিনছেন প্রায় তিন লাখ টাকায়। দালালের মাধ্যমে পাওয়া এই ভিসা নিয়ে কেউ কাজের খোঁজ করছেন, কেউ ইউরোপের দেশগুলোতে পাড়ি দিতে করছেন নানা তদবির-চেষ্টা। তবে অধিকাংশের অভিযোগ, তারা প্রতারণার শিকার। কাজ দেওয়ার প্রলোভন দেখালেও পরে দালালরা দেশটিতে এনে তাদের ছেড়ে দেয়। মাসখানেকের জন্য কাজ পেলেও ভ্রমণ ভিসার মেয়াদ চলে গেলে প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মস্থল থেকে তাদের বের করে দেয়। একদিকে কর্মহীন হয়ে পড়া, অন্যদিকে জরিমানার পরিমাণ বাড়তে থাকায় অসহায় পড়ে পড়েন এসব প্রবাসী।

অন্যদিকে ইউরোপ পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে দুবাইয়ের এই ভ্রমণ ভিসা কোনো কোনো দালাল বিক্রি করেন ১৩-১৫ লাখ টাকায়। সিলেটের শফিকুল ইসলামসহ এই শর্তে একই দালাল থেকে ভিসা নিয়ে দুবাই এসেছেন আরও ছয়-সাতজন। এক মাসের মাথায় তাদের ইউরোপ পাঠানোর কথা থাকলেও অপেক্ষার চার মাস কেটে গেছে। কখনও শারজাহ কখনও আজমান- এই করে শফিকুলদের সময় যাচ্ছে।

সিলেটের শফিকুল ইসলাম সাংবাদিক নূরে আলম পারভেজকে বলেন, দেশ থেকে আসার আগে দালাল বলেছিলেন ইউরোপ পাঠাবে। কিন্তু দুবাই আসার পর তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। শেষ হয়ে গেছে ভ্রমণ ভিসার মেয়াদ। এতগুলো টাকা দিয়ে এখন আমরা দিশেহারা।

জানা যায়, দুবাই থেকে চুক্তির মাধ্যমে কিছু ট্রাভলস এজেন্সি এসব ভ্রমণ ভিসাধারীদের লিবিয়া, পর্তুগাল, মাল্টাসহ ইউরোপের বেশকিছু দেশে পাঠায়। আকাশ পথে তারা যেতে পারে। কিন্তু অধিকাংশই দালালের মাধ্যমে সমুদ্র পথে অবৈধভাবে ইউরোপ যাত্রা করে। প্রথমে দুবাই থেকে ওমান। এরপর ওমান থেকে ইরান, ইরান থেকে তুরস্ক হয়ে পথ ধরেন গ্রিসের। লম্বা এই পথ পাড়ি দিতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের সীমান্তে অনেকে আটক হন। কারও কারও আসে মৃত্যুর খবর। বহু লাশের হদিসও পাওয়া যায় না। বেওয়ারিশ হিসেবে সীমান্তবর্তী এলাকায় দাফন করা হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে তুরস্ক থেকে গ্রিসে যাওয়ার সময় তীব্র ঠান্ডায় প্রাণ হারান এমন ১৯ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী।

এ বিষয়ে জানতে গ্রিসের এথেন্সের বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) বিশ্বজিৎ কুমার পাল ও গ্রিসের স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা হয়। স্থানীয় সাংবাদিকরা জানায়, ভ্রমণ ভিসাধারীদের অনেকে দুবাইয়ে ভিসার ধরন পরিবর্তন করে সমুদ্রপথে দুবাই থেকে ইরান দিয়ে ইউরোপের পথ ধরেন। প্রথমে ইরান, ইরান থেকে তুর্কি, তুর্কি থেকে ইতালি যান তারা। কেউ কেউ তুর্কি থেকে সড়ক পথেও যেতে পারেন ইউরোপের দেশ গ্রিসে। গ্রিসে ঢুকে গেলে সেখান থেকে সহজে সেনজেনভুক্ত ২৬ থেকে ২৮টি দেশে যাওয়ার সুযোগ পান তারা। তবে এই পথে জীবনের ঝুঁকি আছে। আটক কিংবা মৃত্যু ঝুঁকি অনেক বেশি। সীমান্তে মারা গেলে বেওয়ারিশ হিসেবে লাশ দাফন করা হয়। আর গ্রিসের ভেতরে প্রবেশের পর মারা গেলে তাদের তুরস্ক থেকে অনুপ্রবেশ করার সময় মারা গেছে মর্মে হিসাব করা হয়।

এথেন্সে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) বিশ্বজিৎ কুমার পাল জানান, যারা অবৈধভাবে ইউরোপ প্রবেশ করে তাদের সঠিক কোনো তথ্য নেই। অবৈধ পথে আসার সময় কেউ মারা গেলে সেই হিসাবও ধরা হয় না। তবে গ্রিসের ভেতরে মারা গেলে যদি স্বজনরা যোগাযোগ করেন তখন দূতাবাস সেই লাশের খোঁজখবর করে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশি হিসেবে শনাক্ত করতে পারলে দূতাবাসকে খবর দেয়।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top