জনবান্ধব পুলিশিংয়ের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পুলিশকে কাজ করার আহবান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে দেশের গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করতেও বলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্যোগে ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সেবামূলক কর্মকাণ্ডে পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা বেড়েছে। সরকারের নেয়া নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে পুলিশ এখন প্রযুক্তিনির্ভর বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। গতকাল রবিবার সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পাঁচ দিনব্যাপী পুলিশ সপ্তাহ-২০২২ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে এ আহবান জানান তিনি।
‘দক্ষ পুলিশ, সমৃদ্ধ দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’-এ স্লোগানে শুরু হয়েছে পুলিশ সপ্তাহ। গতকাল সকাল ১০টায় রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স মাঠে বার্ষিক পুলিশ প্যারেডের মধ্য দিয়ে পুলিশ সপ্তাহ-২০২২ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি প্যারেডে ভার্চুয়ালি উপস্থিত থেকে পুলিশের বিভিন্ন কন্টিনজেন্ট এবং পতাকাবাহী দলের সুশৃঙ্খল, দৃষ্টিনন্দন প্যারেড পরিদর্শন ও অভিবাদন গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল অনুষ্ঠানস্থলে এসে দৃষ্টিনন্দন প্যারেড পরিদর্শন করেন। বার্ষিক পুলিশ প্যারেডে অধিনায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দেন পুলিশ সুপার মো. ছালেহ উদ্দিন। তার নেতৃত্বে বিভিন্ন কন্টিনজেন্টের পুলিশ সদস্যরা প্যারেডে অংশ নেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগে প্রথম পুলিশ সপ্তাহ উদযাপনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ভাষণ থেকে উদ্ধৃত করে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এই রাজারবাগে যারা শহীদ হয়েছিলেন, তাদের কথা মনে রাখতে হবে। তারা আপনাদেরই ভাই। তাদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। বিএনপির আগুন সন্ত্রাস দমনসহ পুলিশের নানা ভূমিকার প্রশংসা করে সরকার প্রধান বলেন, করোনার সময় স্বজনরা লাশ ফেলে চলে গিয়েছিলো, কিন্তু পুলিশ সদস্যরা সেই লাশ দাফন করেছে। তাই মানুষের কাছে পুলিশের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে।
nagad
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৯৯৯ নম্বরের কারণে পুলিশ আরও বেশি মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারছে। পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা সৃষ্টি হয়েছে ও আস্থাও বেড়েছে। যেমন নির্মমভাবে পুলিশের সদস্যদের বিএনপি মেরেছে, তা সত্যিই ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। এ ধরনের ঘৃণ্য কাজ করে তারা দেশে একটি অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। কত মানুষকে যে তারা হত্যা করেছে, তার সীমা নেই। সে সময় পুলিশ বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে মানুষের জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা এনেছে। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তারা কাজ করেছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও করোনাকালে নানা প্রতিকূলতা পাশ কাটিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর গেল ১৩ বছরে পুলিশ বাহিনীর উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে বলে উল্লেখ করে পুলিশকে সব সময় দেশের মানুষের উন্নয়নে কাজ করার নির্দেশ দেন সরকার প্রধান।
তিনি জানান, দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করাই আওয়ামী লীগ সরকারের লক্ষ্য। ক্ষমতায় এসে পুলিশের বাজেট ৪০০ কোটি টাকা থেকে দ্বিগুণ করা হয়েছে। বাজেট যেমন বৃদ্ধি করেছি, রেশন বৃদ্ধি করেছি এবং আমাদের নারী পুলিশদের জন্য আরো ব্যবস্থা রেখেছি। পুলিশকে প্রযুক্তিনির্ভর বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষার পাশাপাশি গণতন্ত্র রক্ষায়ও পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।এসময় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা ও শান্তি রক্ষা মিশনে পুলিশ তথা নারী কন্টিনজেন্টের ভূমিকারও প্রশংসা করেন সরকার প্রধান।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার রাতে পুলিশের সাহসী ভূমিকার কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমার বাবার ছোট বোনের বাড়িতে যখন আক্রমণ করে, তখন আক্রমণকারীরা আমার ফুফা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এবং তার নাতি সুকান্তসহ সবাইকে হত্যা করে। গুলিতে আমার ফুফু আহত হন। যখন এই খুনিরা আক্রমণ করে চলে যায়, তখন রমনা থানা থেকে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এই আহত সদস্যদের হাসপাতালে নিয়ে যায়। এর ফলে আমার ফুফু গুলি খেয়েও পঙ্গু অবস্থায় বেঁচে থাকে শুধুমাত্র পুলিশের সাহসী ভূমিকার জন্য। আমাদের বাসায় যখন আক্রমণ করা হয়, তখন এসবির এএসপি ছিলেন সিদ্দিকুর রহমান। খুনিরা যখন দোতলায় যেতে চায়, তখন তিনি সাহসিকতার সাথে বাধা দিয়েছিলেন।
সরকারপ্রধান বলেন, পুলিশ ট্রাস্ট ফান্ডের জন্য ৫ কোটি টাকা সিড মানি প্রদান করি, যাতে পুলিশের কল্যাণ হয়। পুলিশের জন্য স্টাফ কলেজ করে দিই প্রশিক্ষণের জন্য। পুলিশ সদস্যদের জন্য ঝুঁকিভাতা প্রবর্তন করি। তিনি বলেন, কমিউনিটি পুলিশ গঠন করে জনগণের সাথে সম্পৃক্ত থেকে আইন শৃঙ্খলা যাতে রক্ষা করতে পারি সে ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। ২০০১ এ আমরা সরকারে আসতে পারিনি। ২০০৮ এ জয়লাভ করে সরকার গঠন করি। এরপর থেকে পুলিশের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমুলক কাজ করে গেছি। বেতন-ভাতা সবকিছু বৃদ্ধি করেছি। সেই সাথে পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে ৮২ হাজার ৫৮৩টি নতুন পদ সৃষ্টি করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, পুলিশের জন্য নতুন ইউনিট যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌ পুলিশ, পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন, এন্টি টেররিজম, কাউন্টার টেররিজম, রংপুর ও ময়মনসিংহ রেঞ্চ, রংপুর ও গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ গঠন করেছি। আমরা দুটি সিকিউরিট অ্যান্ড প্রটেকশন ব্যাটালিয়ন এয়ারপোর্টে একটি ও কক্সবাজারে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন গঠন করেছি। প্রত্যেকটা থানা যেগুলো জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল আমরা ভবন করে দিই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর আইজিপি র্যাংক যেটা জাতির পিতা দিয়েছিলেন, সামরিক শাসকরা এসে তা কেড়ে নিয়ে যায়। আমরা সরকার গঠনের পর আবারও আইজিপি র্যাংক ব্যাজ প্রবর্তন করি। আকাশপথে সক্ষমতা অর্জন করতে দুটি হেলিকপ্টার ক্রয়ের প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে। তিনি আরো বলেন, আগে যে জায়গাগুলোতে সীমিত আকারে ছিল, আমরা শতভাগ রেশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। চাকরিরত অবস্থায় যদি কেউ মৃত্যুবরণ করে বা গুরুতর আহত হয় তাদের আর্থিক অনুদান বৃদ্ধি করা হয়েছে। রাজারবাগে ১০ তলা ভবন করে পুলিশের জন্য আলাদা হাসপাতাল করে দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় আরও হাসপাতাল করে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
সম্মানসূচক পদক পেলেন ২৩০ পুলিশ সদস্য: প্রতি বছর পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে পুলিশ সদস্যের সাহসিকতা, বীরত্বপূর্ণ ও সেবামূলক কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পদক দেয়া হয়। করোনা মহামারীর কারণে গত বছর এই আয়োজন বন্ধ থাকায় ২০২০ ও ২০২১ সালের পুরস্কার গতকাল একত্রে দেয়া হয়। দুই বছরে পদক পেয়েছেন মোট ২৩০ জন পুলিশ সদস্য।
সম্প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ শাখা র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এন নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থাকা সাত মাস আগে র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পাওয়া অতিরিক্ত আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে সম্মানজনক এই পদক দেয়া হয়েছে। এছাড়া দায়িত্ব পালন করতে জীবন দেয়া র্যাবের দুইজন সহ ৯ জন পুলিশ সদস্যকে মরণোত্তর পদক দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে পুলিশ সদস্যদের পদক তুলে দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
৫ দিনব্যাপী পুলিশ সপ্তাহের (২৩-২৭ জানুয়ারি) দ্বিতীয় দিন সোমবারের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে-শিল্ড প্যারেডের ফাইন প্রতিযোগিতা, প্রীতিভোজ, সন্ধ্যায় অবসরপ্রাপ্ত ও বর্তমান কর্মকর্তাদের পুনর্মিলনী। তৃতীয় দিন মঙ্গলবার সকালে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এদিন বিকালে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রধান বিচারপতির সম্মেলন এবং সন্ধ্যায় ভার্চুয়ালি ভাষণ দেবেন রাষ্ট্রপতি। ২৬ জানুয়ারি ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আইজিপির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। পুলিশ সপ্তাহের শেষ দিন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রীর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
এদিন বিকালে উচ্চপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মন্ত্রীপরিষদ সচিবের সম্মেলনের মাধ্যমে সপ্তাহের কার্যক্রম শেষ হবে। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের দরবার এবার করোনার কারণে বাতিল করা হয়েছে। পুলিশের দাবিগুলো প্রধানমন্ত্রীকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।