এখনই তাইওয়ানে আগ্রাসন শুরু করতে যাবে না চীন। কিন্তু দুটি দেশই বিপজ্জনক এক পথে রয়েছে। তাইওয়ানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সাবেক জেনারেল চিউ কুও-চেং গত সপ্তাহে দেশের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে গেলেন। দিলেন একটি পূর্বাভাস। বললেন, ২০২৫ সালের মধ্যে তাইওয়ানের বিরুদ্ধে পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসন চালাতে সক্ষম হবে চীন। এই দ্বীপরাষ্ট্রটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সমুদ্রভাগের ওপর দিয়ে সম্প্রতি চীন সর্বোচ্চ সংখ্যক যুদ্ধবিমান পাঠায়। তা নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে শুধু তাইওয়ানে, এমন নয়। এই উত্তেজনা নাড়া দিয়েছে বিশ্বকেও।
জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বঙ্গবন্ধুর নামে বেঞ্চ উৎসর্গ ঐতিহাসিক ঘটনা: প্রধানমন্ত্রী
এরপরই পার্লামেন্টে ওই ঘোষণা দিলেন মন্ত্রী জেনারেল চিউ কুও-চেং। সম্ভবত তিনি যথার্থই বলেছেন- এমনটা বলছেন বিশ্লেষকরা। কারণ, তারাও বিশ্বাস করেন তাইওয়ানকে নিজেদের ভূখণ্ড দাবি করলেও সহসা সেখানে আগ্রাসন চালাবে না চীন। এ খবর দিয়েছে অনলাইন সিএনএন।
১৯৪৯ সালে চীনের গৃহযুদ্ধের পরে চীন থেকে জাতীয়তাবাদী সরকার পালিয়ে চলে যায় তাইওয়ানে। তারাই সেখানে আলাদা রাষ্ট্র গড়ে তোলে। কিন্তু ওই সময় থেকেই তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে বেইজিং থেকে আগ্রাসী ভাবধারা শুরু হয়। ২০০০ সালের শুরুর দিকে বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, এক দশকের মধ্যে তাইওয়ানকে দখল করে নিতে পারে বেইজিং। তারপর ২০১৩ সালে তাওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তার প্রক্ষেপণে বলে যে, ২০২০ সালের মধ্যে তাইওয়ানে আগ্রাসন চালাতে পারে বেইজিং। কিন্তু কোনো পূর্বাভাসই সত্য হয়নি।
সম্প্রতি তাইওয়ান প্রণালীতে আকাশপথে বেইজিং যুদ্ধবিমানের মহড়া চালালেও তাইওয়ানের রাজধানী তাইপে’তে জনজীবন রয়েছে স্বাভাবিক। আগ্রাসন নিয়ে জনগণের তেমন কোনো উদ্বেগ নেই। এই আগ্রাসনের কথা সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পৃষ্ঠায় তেমন দেখা যায় না।
এর অর্থ এই নয় যে, উদ্বেগ থাকার কোনো কারণ নেই।
বেইজিং দীর্ঘদিন ‘এক চীন’ নীতির সফলতা অর্জনের চেষ্টা করছে। এর উদ্দেশ্য এই দ্বীপটিকে মূল চীন ভূখণ্ডের সঙ্গে একীভূত করা। এ জন্য তাইওয়ানের ওপর সামরিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক চাপ তীব্র করছে বেইজিং। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তা হলো, যদি চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) নেতারা মনে করেন, শান্তিপূর্ণ একীভূতকরণের কোনো আশা নেই, তাহলে তাদের উচ্চাকাঙ্খা বাস্তবায়নে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেন।
অক্টোবরের প্রথম ৫ দিনে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির বিমান বাহিনীর কমপক্ষে ১৫০টি যুদ্ধবিমান তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষা জোনে প্রবেশ করে। ওই এলাকাটি তাইওয়ান দ্বীপটিকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। জবাবে তাইপে বলেছে, কোনো আগ্রাসন হলে তারা পাল্টা জবাব দেবে। চীনের এই তৎপরতা শুরু হয় ১লা অক্টোবর সেখানকার জাতীয় দিবসে। শুধু যদি এদিনই এমন ঘটনা ঘটতো তাহলে বোঝা যেত জাতীয় দিবস উদযাপনের অংশ হিসেবে তারা মহড়া দিয়েছে। কিন্তু এরপর টানা চারদিন একই কাজ করেছে। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সম্পর্ক অবনতি হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সম্পর্কের এই অবনতি দুটি কারণে। প্রথমত, ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাইপের রয়েছে উষ্ণ সম্পর্ক। এ জন্য তারা কিছুটা আত্মবিশ্বাসী এবং ক্রমশ ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। দ্বিতীয় হলো, চীনের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি।
চীন এবং তাইওয়ান আলাদা দেশ হিসেবে কমপক্ষে ৭০ বছর শাসিত হয়ে আসছে। তা সত্ত্বেও দুই কোটি ৪০ লাখ মানুষের দ্বীপ তাইওয়ানকে তারা নিজেদের ভূখণ্ড বলে মনে করে। নিয়মিত এই দ্বীপটিকে নিজেদের ভূমির সঙ্গে একীভূত করার প্রত্যয় ঘোষণা করে। তবে তাইওয়ান এই ৭০ বছরের মধ্যে কখনোই চীনের কমিউনিস্ট পার্টির হাতে শাসিত হয়নি। গত ৪০টি বছর এই দ্বীপটিকে কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিতে কাজ করেছে বেইজিং। বিভিন্ন দেশকে সাপোর্ট দেয়ার বিনিময়ে তাইওয়ানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করানোয় ভূমিকা রেখেছে চীন। ফলে বর্তমানে তাইওয়ানের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে মাত্র ৪৫ টি দেশের। বেইজিংয়ের এমন সর্বোত্ব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, ২০২০ সালের শুরু থেকে অধিক পরিমাণ বৈশ্বিক সমর্থন অর্জন করেছে। দেশটির চারপাশে যেসব দেশ আছে, তারা তাইওয়ানের স্বশাসনের অধিকারের প্রতি অবস্থান নিয়েছে। আগে কখনো এমনটা দেখা যায়নি।
সিএনএন’কে জাপানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী নোবু কিশি বলেছেন, তাইওয়ানের বিরুদ্ধে চীন যদি শক্তি প্রয়োগ করে তাহলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে টোকিও। অন্যদিকে তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক আরো দৃঢ় করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারিস পাইনে। এই সমর্থন এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের বাইরে থেকেও আসছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নিজেদের স্বনামে কয়েক দশকের মধ্যে তাইওয়ানকে একটি কূটনৈতিক মিশন খোলার জন্য ইউরোপিয়ান প্রথম দেশ লিথুয়ানিয়া অনুমতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাইওয়ানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে তারা বিশ্বমঞ্চে শক্তিশালী অবস্থান পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের অধীনে ২০২০ সালে কয়েক দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সংখ্যক উচ্চ পদস্থ ভিজিটরকে স্বাগত জানিয়েছে তাইওয়ান। বেইজিং হতাশ এই কারণে যে, যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের সেই ধারাকে পাল্টে দেননি। গ্লোবাল ইনস্টিটিউট তাইওয়ানের তাইপেভিত্তিক সিনিয়র ফেলো জে. মাইকেল কোল বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা তাইওয়ানের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করেছে।