Monday , 23 December 2024
সংবাদ শিরোনাম

একজন সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মকফর উদ্দিন

মাহাবুব তালুকদার:

একজন অন্যতম ও সম্মুখ সারির সশস্ত্র প্রতিরোধকারী শরীয়তপুরের ডামুড্যার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মকফর উদ্দিন বেপারী ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ সর্ব প্রথম পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয় জয়দেবপুর, টঙ্গী, গাজিপুর এবং টাঙ্গাইল এলাকাতে।ঐতিহাসিক ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু’র ভাষণের পর দেশ স্বাধীনতা ও মুক্তির আন্দোলনে যখন উত্তাল তখনই প্রথম পাক হানাদার বাহিনীর অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলা হয়। এ ঘটনার পর সারাদেশে শ্লোগান ওঠে ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।

তৎকালিন সময়ে যারা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তাদের মধ্যে একজন অন্যতম ও সম্মুখ সারির সশস্ত্র প্রতিরোধকারী শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা থানার দারুল আমান ইউনিয়নের নান্দ্ররা গ্রামের মরহুম আঃ গণী বেপারীর কনিষ্ঠ পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মকফর উদ্দিন বেপারী।

মোঃ মকফর উদ্দিন বেপারী ২৭ জুলাই ১৯৪৮ সালে ডামুড্যা থানার দারুল আমান ইউনিয়নের নান্দ্ররা গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।

তার সাক্ষাৎকার নিতে গেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মকফর উদ্দিন বেপারী নিউজ ফেয়ারকে জানান, আমি ২৭/০৭/১৯৬৬ ইং তারিখে তৎকালিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করি। ৬ মাস ট্রেনিং এর পরে পাকিস্তানের লাহোরে সেকেন্ড ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের আমাকে পোস্টিং করে। তার পরে ৩ বছর পরে ১৯৬৯ সালে ঢাকা জয়দেবপুর বদলি করে সেকেন্ড ইস্টবেঙ্গল এর সবাইকে। তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে ব্রিটিশ অস্ত্র ছিল। সেই বছর নতুন করে চায়না অস্ত্র তাদের কাছে আসলে পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে যেই অস্ত্র ছিলো সেগুলো ঢাকা কেন্টোনম্যান্টে জমা দেয়ার কথা বলেন। জমা দেয়ার কোন রশিদ দিবে না তাই পূর্ব পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তা জমা দেননি।

তৎকালিন সেকেন্ড ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন লেঃ কর্নেল মাকসুদুল হক। তাকে ঢাকা সেনানিবাসে আটকিয়ে রাখে। সেকেন্ড ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ৫ টি কম্পানি ভাগ ছিলো। ১ম ছিলো রাজন্দ্রপুর, ২য় ছিলো টঙ্গীতে এবং ৩য় ছিলো টাঙ্গাইল কোট বিলিংয়ে। আমি তখন টাঙ্গাইল ছিলাম, আমাদের ভিতর ভয় কাজ করতে ছিলো যে কোন সময় আমাদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়ার জন্য আক্রমণ করতে পারে এই ভেবে। মুক্তিকামি জনতা টঙ্গী হতে জয়দেবপুর পর্যন্ত বিভিন্ন গাছ দিয়ে রাস্তায় বেরিকেট দেয় এবং প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেন। আমরা সবাই ভিতরে ভিতরে বিদ্রোহ করি। তৎকালিন সময় আওয়ামী লীগের নেতৃতে পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিবার যারা ছিলো তাদের বাড়িতে বাড়িতে সবাইকে পৌছাইয়া দেন।

আমাদের কম্পানির কাছে গোপনে একটা ওর্ডার আসে, ঢাকা থেকে সবাই যখন টাঙ্গাইল পৌছাইবো তখন, জয় বাংলা স্লোগান দিলে আমাদের কম্পানি কমান্ডার সহ পশ্চিম পাকিস্তানের যারা আছে, তাদের কে মেরে ফেলার। আমরা অধির অপেক্ষায় ছিলাম কখন সবাই আসবে। কিন্তু তখন আমাদের কম্পানির দায়িত্বে ছিলেন মেজর আজিজ কামাল। স্যার অনেক চিন্তায় ছিলেন, বারান্দায় বসে একটা পর একটা সিগারেট টানেন।

আমরা ৪ থেকে ৫ জন সৈনিক বাহিরে পোশাক পড়া অস্ত্র হাতে ডিউটি করতে ছিলাম। টাইম হয়তো রাত ৯টা থেকে ১০টা হবে। এই সময়ের মধ্যে জয় বাংলা মিছিলের শব্দ কানে ভেষে আসে, সাথে সাথে আমি সহ আমার সাথে থাকা সবাই মেজর আজিজ কামাল কে গুলি করে মেরে ফেলি। তারপর আমাদের কম্পানির কয়েকজন সৈনিক পাকিস্তানি যারা ছিলো তাদের খুঁজে খুঁজে মেরে ফেলে। আমরা বের হয়ে সবাই এক সাথে ময়মনসিংহ যাই। ময়মনসিংহ তখন ট্রেন আগে থেকেই রেডি ছিলো ভৌরব যাওয়ার জন্য, কিন্তু সেই সময়ের কিছু কথা মনে পড়লে অনেক ভালো লাগে। ট্রেন থামিয়ে মুক্তিকামী জনতা কেউ ডিম, কেউ গামছা, যে যা পারছে আমাদের দিয়ে সাহায্য করেছে। ভৌরব যেতে যেতে প্রায় ১০ হাজার ডিম মানুষ আমাদের’কে দিয়েছেন। আমরা সবাই কুমিল্লা হয়ে ভারতের তেলিয়াপাড়ায় যাইয়া ক্যাম্প করা হয়। ১ দিন পরেই আমাদের কম্পানি আশুগঞ্জ পাঠিয়ে দেয়া হয়, পাকিস্তান হানাদারদের প্রতিহত করার জন্য। আমাদের কম্পানির দায়িত্ব ছিলেন লেঃ হেলাল মুন্সী।

আমরা ০১ দিন পরেই একটা অপারেশনে যাই। ভৈরব ছিলো তৎকালিন সময়ের সব চাইতে বড় বাণিজ্য কেন্দ্র। আমাদের কম্পানির সবাই হাবিব ব্যাংক লুট করে প্রায় ৭০ কোটি টাকা ও ৬০ কেজি স্বর্ণ নিয়ে আসি। সেই টাকা আর স্বর্ণ ভারত পাঠিয়ে দেই আমরা, আমি যদি ইচ্ছে করতাম সেই টাকা আর স্বর্ণ নিয়ে পালিয়ে যেতে পারতাম, কারন আমি পাহাড়া দিয়েছি অনেক সময় সেই টাকা আর স্বর্ণ, কখনো সেই চিন্তা করি নাই। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এইসব জানতে পারিয়া ব্রাহ্মনবাড়িয়া হেলিকপ্টার দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নেমে অবস্থান করে আমাদের উপর পিছন দিক দিয়ে হামলা করে আকাশ পথে ও স্থল পথে। আমরা সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই, এমন একটা সমস্যা হয়ে যায়, ওদের যেই পোশাক আমাদেরও সেই পোশাক। এমন পরিস্থিতিতে শত্রুর বুকে গুলি চালাতে গিয়ে নিজেদের একজন মারা যান। আমি সহ আরো ৭ থেকে ৮ জন সৈনিক রেললাইন এর পশ্চিম পাশের্বিশ্ব গোডাউনের পাশে বাদাম ক্ষেতে আশ্রয় নেই, কিন্তু পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আমাদের স্থল পথে ও আকাশ পথে আক্রমণ করেই যেতে থাকে। ভাগ্য আমাদের সহায় থাকার কারনে আমি সহ আমার সাথে থাকা কেউ কোন আঘাত পায় নাই।

প্রায় ১ ঘন্টা যুদ্ধ করেছিলাম আমরা। পাশেই একটা নদী ছিলো, নদীর এই পাড় আশুগঞ্জ আর ঐ পাড় ভৌরব। ঐ পাড় থেকে এক ভাই নৌকা নিয়ে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন, তখন জানতে পারি সে একজন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি। তিনি আমাদের সাহায্য করেন, নৌকা দিয়ে আমাদের ভৌরব নিয়ে যান। আমরা সাত আট জন সিলেট মৌলিভি বাজার যাওয়ার জন্য পস্তুতি নেই, তখন লঞ্চের লোক যেতে রাজি হয় নাই। তখন আমরা তাদের অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করি। আমাদের গুলি প্রায় শেষ অবস্থায় ছিলো, তাই সিলেট জাফলং হয়ে ভারতে সরনার্থি ক্যাম্পে যাই। এই সব ঘটনা ২৬ মার্চের ঘটনা।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top