নীতিমালার বেড়াজালে আটকে আছে সোনা আমদানি। কঠোর নীতিমালার কারণে লাইসেন্স নিয়েও সোনা আমদানি করছেন না ডিলাররা।
ফলে দেশের চাহিদা মেটাতে চোরাই পথে আসছে কাঁড়ি কাঁড়ি সোনার চালান। সবচেয়ে বেশি আসছে আকাশ পথে। এতে একদিকে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অপরদিকে বেপরোয়া হয়ে উঠছে চোরাকারবারিরা।
এ পরিস্থিতিতে সংশোধনের মাধ্যমে নীতিমালাটি সহজ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার।
অবৈধ পথে সোনা আনার প্রক্রিয়া সহজ ও লাভজনক হওয়ায় ১৮ লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের মাথায় হাত। গত দুই বছরে লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলো মাত্র ২৫ কেজি সোনা আমদানি করেছে। অথচ এই সময়ে দেশে সোনা প্রবেশ করেছে ১০০ টনের বেশি। বাকি সোনা আসছে চোরাই পথে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এসব বিষয় বেরিয়ে এসেছে। এ সংক্রান্ত নীতিমালায় বলা হয়েছে দেশে বছরে সোনার চাহিদা ৩০ থেকে ৪০ টন। তবে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী বাস্তবে এই চাহিদা ৭০ টনের বেশি। এই অবস্থায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক। শেষ পর্যন্ত বেপরোয়া এই চোরাচালান ঠেকাতে সোনা আমদানির নীতিমালাটি সংশোধন করতে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিদ্যমান নীতিমালায় স্বর্ণ আমদানির পর ব্যবসা এবং মুনাফা করা কঠিন। দুই দফায় কর পরিশোধ ও বার থেকে অলংকার তৈরির পর বিক্রি করলে বাজার দরের চেয়ে বেশি খরচ পড়ে। ফলে দেশে বাণিজ্যিকভাবে সোনা আমদানি হচ্ছে না।
খোদ লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ীরাই বৈধপথে সোনা আমদানি না করে ক্যারিয়ারের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আনছে অবৈধ পন্থায়। হিসাব অনুযায়ী গত দুই বছরে লাইসেন্সধারী ১৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র দুটি ২৫ কেজি সোনা আমদানি করেছে।
অথচ যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বর্তমানে ব্যাগেজ রুলসের আওতায় একজন প্রবাসী বা বিদেশ থেকে আগত বিমান যাত্রী বিনা শুল্কে ১০০ গ্রাম (প্রায় ১০ ভরি) স্বর্ণালংকার অথবা সোনার বার ভরি প্রতি ২ হাজার টাকা শুল্ক দিয়ে ২০০ গ্রাম (প্রায় ২০ ভরি) দেশে নিয়ে আসতে পারেন। স্বর্ণবার বা স্বর্ণালংকার বহনকারীদের প্রায় সবাই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকে আসেন।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার করা এক রিপোর্টে দেখা গেছে, যেসব প্রবাসী সোনা নিয়ে আসছেন তাদের অধিকাংশের মাসিক আয় গড়ে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে। নিজস্ব খরচ মিটিয়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা মাসিক সঞ্চয় বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।
পুরো টাকা সঞ্চয় করলেও একজন প্রবাসীর বাৎসরিক সঞ্চয় সর্বোচ্চ ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা হতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে ১০০ গ্রাম বা ১০ ভরি করে ২টি সোনার বারের মূল্য প্রায় ১২ লাখ টাকা। অনেক প্রবাসী দেশে ফেরার সময় গড়ে ১০ ভরি করে সোনা নিয়ে আসছে, যা তাদের আয়ের সঙ্গে মিলছে না।
গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা নেপথ্যে থেকে এই পুরো টাকাই জোগান দিচ্ছে দেশীয় কোনো চোরাকারবারি। এক্ষেত্রে ওই প্রবাসী ক্যারিয়ার হিসাবে কাজ করছেন। কারণ ১০ ভরি সোনা কিনে দেশে ফিরতে হলে ওই প্রবাসীকে কমপক্ষে একনাগাড়ে ৬ বছর বিদেশে থেকে সঞ্চয় করতে হবে, যা কেউই করেন না। তারা মাসে মাসে টাকা দেশে পাঠিয়ে দেন। অথচ অনুসন্ধানে দেখা গেছে যারা স্বর্ণবার বা স্বর্ণালংকার বহন করছেন তারা প্রতিবছর বা ২ বছর পরপর দেশে আসছেন। নিজের আয়কৃত টাকায় এত বেশি সোনার বার কেনা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই তাদের অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, এসব প্রবাসী ক্যারিয়াররা মূলত চোরাকারবারি বা অন্যের লগ্নিকৃত টাকায় কেনা সোনা দেশে নিয়ে আসেন। এই ক্ষেত্রে তাদের কোনো ধরনের ভ্যাট ট্যাক্স দিতে হয় না। সংস্থাগুলো ধারণা করছে চোরাচালানকারীদের কারসাজিতে এভাবেই সরকার প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। অপরদিকে স্বর্ণ আমদানি করার জন্য অনুমোদিত ডিলাররা নিরুৎসাহিত এবং নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে। জানা গেছে প্রবাসী ছাড়াও এই ক্যারিয়ার চক্রের মধ্যে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের কেবিন ক্রু, ককপিট ক্রু, ইঞ্জিনিয়ারিং সদস্য, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীও জড়িত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, নীতিমালাটি বাংলাদেশ ব্যাংক করেনি। এটি করেছে মন্ত্রণালয়। কোথাও কোনো সমস্যা থাকলে তা নিয়ে মন্ত্রণালয়ের গোচরে আনা হলে সংশোধনের সুযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, সোনার আন্তর্জাতিক বড় বাজার হচ্ছে দুবাই। সেখান থেকেই বেশির ভাগ স্বর্ণ আমদানি করে বিভিন্ন দেশ। বাংলাদেশও তাই করছে। দুবাইয়ে প্রতি ভরি সোনা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫৯ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়।
একজন আমদানিকারককে সোনা আমদানিতে ভরিপ্রতি ২ হাজার টাকা হারে শুল্ক দিতে হয়। এর সঙ্গে পরিবহণ এবং অন্যান্য খরচ প্রায় ২ হাজার টাকাসহ আমদানিতে তার খরচ হয় ৬৩ হাজার টাকা। নীতিমালা অনুযায়ী স্বর্ণবার বিক্রির সময় ৫ শতাংশ ভ্যাট আমদানিকারককেই দিতে হয়। সে অনুযায়ী আরও ৩ হাজার টাকা যোগ হলে মোট মূল্য দাঁড়ায় ৬৬ হাজার টাকা।
দেখা যাচ্ছে সব মিলে যে খরচ পড়ে সেই দামে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে কম দামে দেশে সোনা বিক্রি হয়। যে কারণে নীতিমালা হওয়ার পরও ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে সোনা আমদানি করছেন না। অথচ ব্যাগেজ রুলের আওতায় সোনা আমদানি করতে প্রতি ভরিতে ২ হাজার টাকা শুল্ক প্রদান করতে হয়। এ হিসাবে খরচ পড়ে ৬১ হাজার টাকা। এরপর ঐ স্বর্ণ ভ্যাট ছাড়াই স্বর্ণালংকার দোকানে ৬৬ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ, জুয়েলারি দোকানগুলো ব্যাগেজ রুলের আওতায় আমদানিকৃত স্বর্ণ কিনছে না। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে দেশের জুয়েলারি দোকানে প্রদর্শিত স্বর্ণালংকার কীভাবে তৈরি হচ্ছে?
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৮ সালে স্বর্ণ আমদানির জন্য একটি ব্যাংকসহ ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স প্রদান করে। এগুলো হচ্ছে, মধুমতি ব্যাংক, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড, জুয়েলারি হাউস, রতনা গোল্ড, অরোসা গোল্ড করপোরেশন, আমিন জুয়েলার্স, স্রেজা গোল্ড প্যালেস, জরোয়া হাউস লিমিটেড, মিলন বাজার, এসকিউ ট্রেডিং, এমকে ইন্টারন্যাশনাল, বোরাক কমোডিটিস এক্সচেঞ্জ, গোল্ডেন ওয়ার্ল্ড জুয়েলার্স, রিয়া জুয়েলার্স, লক্ষ্মী জুয়েলার্স, বিডেক্স গোল্ড অ্যান্ড ডায়মন্ড, ডিডামাস ও দি আর্ট অব গ্যালারি। এর মধ্যে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডসহ মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান গত দুই বছরে ২৫ কেজি স্বর্ণ আমদানি করেছে। অথচ দেশের সোনা আমদানি নীতিমালায় বলা হয়েছে, বছরে ২০-৪০ টন সোনার চাহিদার রয়েছে।
শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, ব্যাগেজ আইনে স্বর্ণবার ও স্বর্ণালংকার নিয়ে আসার সুবিধায় বিশেষ শর্তারোপ করে সরকারের বিপুল রাজস্ব আদায় করা সম্ভব।
এই ক্ষেত্রে নীতিমালায় প্রবাসীদের জন্য প্রবাসজীবনে সর্বনিম্ন ৫ বছর অবস্থান করে সর্বোচ্চ ১০ ভরি স্বর্ণালংকার এবং সর্বনিম্ন ২ বছর অবস্থান করে সর্বোচ্চ ৫ ভরি স্বর্ণালংকার নিয়ে আসার বিধান রাখা যেতে পারে।
একই ধরনের স্বর্ণালংকার সর্বোচ্চ ২টির বেশি হতে পারবে না এমন আইন করা হলে ব্যাগেজ আইনে চোরাকারবারিদের প্রলোভনে অবৈধ উপায়ে দেশে স্বর্ণালংকার প্রবেশ রোধ করা সম্ভব।
ব্যাগেজ আইনে প্রবাসীদের সঙ্গে নিয়ে আসা স্বর্ণালংকারের ক্রয় রসিদ যাচাই-বাছাই, পাসপোর্টে গোল্ড এন্ডর্সমেন্ট নিশ্চিতকরণ এবং প্রবাসীদের পাসপোর্টের তথ্যাদি সংরক্ষণ করা হলে যে কোনো ক্ষেত্রে এই স্বর্ণ কিংবা স্বর্ণালংকার বিক্রয়ে সরকারের রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করা সম্ভব।
সোনা আমদানিকারকরা বলেছেন, ব্যাগেজ আইনে ব্যক্তিগত ব্যবহারের স্বর্ণালংকার নিয়ে আসার সুবিধা থাকলেও স্বর্ণবার নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তা বাতিল করা উচিত।
বর্তমানে স্বর্ণবার আমদানির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কতৃক নিবন্ধিত বৈধ আমদানিকারক রয়েছে। সুতরাং স্বর্ণবার আমদানির ক্ষেত্রে এই সুবিধা শুধু বৈধ আমদানিকারকদের মধ্যে সীমিত রাখা প্রয়োজন। এতেই সোনা আমদানি নীতিমালা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।