নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা দুর্নীতির মাধ্যমে টাকার কুমির বনে যাওয়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক আবদুল মালেক ওরফে বাদলকে র্যাবের জিজ্জাসাবাদে বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। চতৃর্থ শ্রেণির কর্মচারী মালেক স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ এ খাতের অনেক রাঘববোয়াল দুর্নীতিবাজদের নাম প্রাথমিক জেরাতেই প্রকাশ করেছেন।
তাদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর ও প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন(র্যাব) ও দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক)। এদের কেউ কেউ নজরদারিতেও রয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শিগগিরই কয়েকজনকে ডাকা হচ্ছে। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে অন্তত ২৫ কর্মকর্তা-কর্মচারী গ্রেফতার আতঙ্কে রয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে রিমান্ডে থাকা মালেককে টানা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়েছে বলে র্যাবের সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক দুই মহাপরিচালকের (ডিজি) গাড়িচালক মালেকের বিপুল টাকা ও বিত্তবৈভবের খবর প্রকাশ হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্ন উঠেছে। তাদের প্রশ্ন, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী শত কোটি টাকা ও তৃতীয় শ্রেণি হাজার কোটি টাকার মালিক হলে ‘বড়দের’ কত ? এমন আলোচনা-সমালোচনা ও বিশ্লেষণ চলছে নানা মহলে। বিভিন্ন সেক্টরে এমন মালেক শত শত রয়েছে অনেকের মন্তব্য।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট র্যাব কর্মকর্তারা জানান, মালেককে গ্রেফতারের সূত্র ধরে শিগগিরই স্বাস্থ্য খাতের আরো কয়েকজন দুর্নীতিবাজ আটকা পড়তে পারেন। তারা দীর্ঘদিন ধরে একই পদে থেকে নিয়োগ, বদলি, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এ জাতীয় দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মচারিদের বিষয়ে নিবিড় অনুসন্ধানে নামা হচ্ছে বলে দুদক সূত্রও জানিয়েছে।
জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, যারা অপরাধ করবে তাদের কিছুতেই ছাড় দেয়া হবে না। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গাড়িচালক আবদুল মালেকের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে আরো তথ্য মিলবে। মালেকের সঙ্গে অনেকের যোগসাজশ ছিল। প্রাপ্ত তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক ডিজির গাড়িচালক মালেককে গত রবিবার রাজধানীর তুরাগ এলাকা থেকে গ্রেফতার করে র্যাব-১ এর একটি দল। তার বিপুল সম্পদের তথ্য পেয়ে বিস্মিত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অবৈধ অস্ত্র ও জাল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় করা পৃথক দুই মামলায় সোমবার মালেকের ১৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
তদন্ত সংশ্নিষ্ট র্যাব কর্মকর্তারা জানান, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পডুয়া মালেক জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবকে জানিয়েছেন, এক যুগেরও বেশী সময় ধরে তিনি নিয়োগ-বাণিজ্য করেই সবচেয়ে বেশি অর্থ কামিয়েছেন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মচারী সমিতি ও চালক সমিতির নিয়ন্ত্রণ তার হাতে ছিল। নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য ছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যে কোনো অনুষ্ঠানের আলোকসজ্জা বা অন্যান্য ডেকোরেশনের কাজও তার পছন্দমতো হতো। বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকালেও তালিকায় মালেকের নাম ছিল। তখন কিছুদিনের জন্য আত্মগোপনে ছিলেন শত কোটি টাকার মালিক এই গাড়িচালক।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মালেকের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ ছিল তাদের প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন পরিচালককে জিম্মি করে ডাক্তারদের বদলি, পদোন্নতি, তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়োগের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করেছেন তিনি।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তার মেয়ে নওরিন সুলতানাকে কম্পিউটার অপারেটর, ভাই আবদুল খালেককে অফিস সহায়ক, ভাতিজা আবদুল হাকিমকে অফিস সহায়ক, বড় মেয়ের স্বামী রতনকে ক্যান্টিন ম্যানেজার, আত্মীয় কামাল পাশাকে অফিস সহায়ক, ভায়রা মাহবুবকে ড্রাইভার এবং ভাগ্নে সোহেলকে ড্রাইভার পদে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চাকরি দিয়েছেন তিনি। মহাপরিচালকের পাজেরো গাড়িটি হরহামেশাই ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন।
সূত্র জানায়, গ্রেফতারের পর চালক মালেক স্বাস্থ্য খাতের অন্তত ৩০ জন দুর্নীতিবাজের নাম ফাঁস করেছেন। পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতের আরও কয়েকজন রাঘববোয়ালের নাম ফাঁস করেছেন মালেক। যারা অনেক দিন ধরেই এ খাত থেকে নানাভাবে লাভবান হয়ে আসছিলেন। কর্মচারীদের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের একান্ত সহকারী (পিএ) হিসেবে কর্মরত শাহজাহান কবিরে নাম রয়েছে। এ ছাড়া প্রশাসনিক কর্মকর্তা কবির হোসেন চৌধুরী, জাহাঙ্গীর আলম , হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মজিবুল হক মুন্সি ও ডাটা এন্ট্রি অপারেটর তোফায়েল আহমেদ ভুঁইয়াসহ অনেকে নাম বেরিয়ে এসেছে।
এ ছাড়া কয়েকজন চিকিৎসক নেতার নামও প্রকাশ করেছেন মালেক। তাদের প্রত্যেকের ব্যাপারে র্যাব ও দুদক পৃথকভাবে খোঁজ খবর নিচ্ছে। এদের অনেকে গ্রেফতার আতঙ্কে রয়েছেন।