অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ঝুঁকি তুচ্ছ করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় থেকেই এ দেশ একটি ট্র্যাজেডির দেশ হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে। দারিদ্র্যের করাল থাবা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর পৃথিবীর বৃহত্তম শরণার্থীর ধকল সইছে এখন বাংলাদেশ। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখন বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম সাফল্যের গল্প। বার্ষিক প্রবৃদ্ধি, গড় মাথাপিছু আয় ও দৈনিক আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন ও রপ্তানি বৃদ্ধিসহ সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই উন্নয়নযাত্রা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
গতকাল বুধবার জাপানভিত্তিক সাময়িকী নিক্কেই এশিয়ান রিভিউয়ের এক প্রতিবেদনে এভাবেই বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাফল্য ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদানকে তুলে ধরা হয়েছে। কর্মরত গার্মেন্ট শ্রমিকদের পটভূমিতে রেখে শেখ হাসিনার ছবিসংবলিত ‘দ্য রাইজ অ্যান্ড দ্য রাইজ অব বাংলাদেশ : দ্য ইকোনমি ইজ বুমিং, ডাজ শেখ হাসিনা ডিজার্ভ দ্য ক্রেডিট’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন গতকাল সাময়িকীর কাভার স্টোরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের এই সাফল্যের গল্পের (সাকসেস স্টোরি) পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের উৎপাদন খাতের অসামান্য অবদান। বর্তমানে রপ্তানিতে বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প খাত। পোশাক রপ্তানিতে দেশটির আগে রয়েছে শুধু চীন।
এক দশক ধরে বাংলাদেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬ শতাংশের বেশি। এটি এ বছরের জুনে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭.৮৬ শতাংশে। ১৯৭৪ সালে দেশটিতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের পরও ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে দেশটি সাড়ে ১৬ কোটি জনগণের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা প্রদানের পাশাপাশি অর্জন করেছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা।
২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১৭৫০ ডলার। দেশটিতে দারিদ্র্যের হারও বেশ কমে এসেছে। ২০০৯ সালে যা ছিল ১৯ শতাংশ, তা বর্তমানে মাত্র ৯ শতাংশ এবং এ দেশে যেসব মানুষ খুব দরিদ্র তাদেরও দৈনিক আয় গড়ে প্রায় ১.২৫ ডলার।
এ বছরের শুরুতেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের দেওয়া শর্তগুলো পূরণ করে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বেরিয়ে আসে এবং বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে দেশটি ২০২৪ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আবির্ভূত হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এই অগ্রযাত্রাকে ‘উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে’ তুলে দেওয়ার অর্থ হলো দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধির জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
ডিসেম্বর মাসে নিক্কি এশিয়ান রিভিউকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হাসিনা বলেছিলেন, ‘নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়া আমাদের কিছু শক্তি ও আত্মবিশ্বাস দিয়েছে, যেটি শুধু রাজনীতিবিদের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, জনগণের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যখন নিম্ন পর্যায়ে থাকবেন স্বাভাবিকভাবে তখন কোনো কর্মসূচি অথবা প্রকল্প নিতে গেলে আপনাকে অবশ্যই অন্যের দয়ার ওপর চলতে হবে। কিন্তু যখনই আপনার উন্নয়ন হবে তখন আপনার কারো ওপর নির্ভর করতে হবে না। কারণ আপনার নিজের অধিকার আছে।’
ওই সাক্ষাৎকারে হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশের এই শক্তিশালী অর্থনীতি শুধু অব্যাহতই থাকবে না, এর গতি আরো বাড়বে।’ এ বিষয়ে হাসিনা বলেন, ‘আমরা আশা করছি পরবর্তী পাঁচ বছরে আমাদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। আর ২০২১ সালের মধ্যেই আমরা ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারব।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সরকারের লক্ষ্যকেও ছাড়িয়েছে। এ বছরের জুন নাগাদ ৩৬.৭ বিলিয়ন ডলার পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। পোশাকশিল্পে এমন উন্নতি অব্যাহত থাকলে ২০১৯ সালে পোশাক রপ্তানি করে ৩৯ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্য পূরণ করবে।
বাংলাদেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ প্রবাসে থাকে, যাদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশটির অন্যতম মূল চালিকাশক্তি। ২০১৮ সালের হিসাব নাগাদ বার্ষিক আয়ের প্রায় ১৮ শতাংশ রেমিট্যান্স থেকে আসে, যার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু শেখ হাসিনা জানেন, এই প্রবাসীদের পাশাপাশি দেশের শিল্পকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
২০০৯ সালে ক্ষমতা নেওয়ার পর হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ নামে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী বেশ এগিয়ে গেছে দেশটি। আইটি সেক্টরের সিইওরা প্রতিবেশী ভারতের চেয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য উৎপাদনেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, যেখানে ভারতের প্রাধান্য রয়েছে। বাংলাদেশের সরকার এখন ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ইতিমধ্যে ১১টির কাজ প্রায় সম্পন্ন এবং ৭৯টির কাজ চলছে। এ ছাড়া সরকার দেশের অধিক ঘনত্বের জনসংখ্যাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে।
এই অভূতপূর্ব সাফল্য ও লক্ষ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য বিরক্তিকর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অবকাঠামো এবং তার থেকেও বাজে বাধা রাজনৈতিক বিভক্তি। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন সামনে রেখে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার পাশাপাশি সর্বদা কর্তৃত্ব ধরে রেখেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, যাঁর পরিবারের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সম্পর্কের ইতিহাস রয়েছে। এই দুই নেতাই পালাক্রমে ক্ষমতায় এসেছে এবং কারাবরণ করেছে বিগত কয়েক দশকে। এদের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন বর্তমানে দুর্নীতির দায়ে কারাগারে রয়েছেন। অবশ্য এটিকে রাজনৈতিক চাল হিসেবে দাবি করে আসছেন তিনি।
১৯৮১ সাল থেকে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। দলটি দেশের প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে জনপ্রিয় দল হিসেবে অংশ নিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি তাদের বিরোধী আন্দোলনকারী এবং মানবাধিকারের বেশ কিছু সংগঠন আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ভোট চুরি ও রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ক্ষমতা গ্রহণের চেষ্টার অভিযোগ তুলছে। দুইবার পাঁচ বছর মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটি নিয়ে বেশ কিছু ভোটারের মধ্যেও বিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে। তার পরও এই ভোটাররা মনে করে, দেশের উন্নয়ন এগিয়ে নিয়ে যেতে আবারও ক্ষমতায় থাকা দলটিকে নির্বাচনে জয়লাভ করতে হবে।
হংকংভিত্তিক ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান সিএলসিএর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মুখ্য কৌশলী কর্মকর্তা ক্রিস্টিফার উড বলেন, যদি অধিক সহিংসতা বা শত্রুভাবাপন্ন অবস্থানকে পাশ কাটিয়ে আবারও দলটি ক্ষমতায় আসতে পারে তাহলে (বাংলাদেশ) সামনে দীর্ঘমেয়াদি ও আকর্ষণীয় সাফল্য অপেক্ষা করছে।
এদিকে ভোট কারচুপি বা রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহার করে ক্ষমতায় যাওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র সুরক্ষায় বদ্ধপরিকর।’ এ ছাড়া ব্যবসার জন্য বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে অবস্থান করছে।
শুধু গার্মেন্ট শিল্প নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে। বিশেষত দেশের বাইরে থেকে আসা বিনিয়োগে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে চীনের অংশগ্রহণ বা চীনের সামরিক খাতে পণ্য সরবরাহ এসব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হারে সাফল্য বাড়ছে। প্রশ্ন উঠেছে, এ ক্ষেত্রে চীনের প্রতি বাংলাদেশ অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে কি? উত্তরটা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেন এভাবে, ‘চীনের এই অঞ্চলে নিজের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা রয়েছে। সে কারণেই এই অঞ্চলে তাদের বিনিয়োগ বেশি। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি বন্ধুভাবাপন্ন ও উন্মুক্ত। যে কেউ চাইলে বিনিয়োগ করতে পারে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পরস্পর সম্পর্কের সঙ্গে আমাদের এই অর্থনৈতিক কার্যক্রমের কোনো সম্পর্ক নেই।’