Monday , 23 December 2024
সংবাদ শিরোনাম

নুরজাহান কেন নারীবাদীদের ‘আইকন’

মুঘল সম্রাজ্ঞী নুরজাহান ছিলেন আঠারো শতকের ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নারীদের একজন। তাঁকে কেন একালের নারীবাদীরা একজন ‘আইকন’ হিসেবে দেখতে চান? ইতিহাসবিদ রুবি লাল বোঝার চেষ্টা করেছেন এই লেখায়:

জন্মের সময় তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিল মিহরুন নিসা। কিন্ত স্বামী মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর পরে তাঁর নাম পাল্টে রেখেছিলেন নুরজাহান (জগতের আলো)। ইংল্যান্ডে রাণী প্রথম এলিজাবেথের জন্মের কয়েক দশক পর  তাঁর জন্ম। কিন্তু রাণী এলিজাবেথের চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ সাম্রাজ্য শাসন করেছেন নুরজাহান।

ষোড়শ শতকের শুরু থেকে পরবর্তী প্রায় ৩০০ বছর ধরে ভারতবর্ষ শাসন করেছেন মুঘলরা। তাঁরা ছিলেন  ভারতের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী রাজবংশ। মুঘল সম্রাট এবং মুঘল রাজ পরিবারের নারীরা ছিলেন শিল্প, সংগীত এবং স্থাপত্যকলার বিরাট সমঝদার। তাঁরা বিশাল সব নগরী, প্রাসাদোপম দূর্গ, মসজিদ এবং সৌধ নির্মাণে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন।

কিন্তু পুরো মুঘল রাজবংশের একমাত্র নারী শাসক নুরজাহানকে নিয়ে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে এখনও ছড়িয়ে রয়েছে অনেক লোকগাঁথা।

উত্তর ভারতের আগ্রা এবং উত্তর পাকিস্তানের লাহোর, মুঘল আমলের দুটি বড় নগরী। এই দুই জায়গায়ই নুরজাহান সম্পর্কে শোনা যাবে অনেক কিংবদন্তি।

প্রবীণ নারী এবং পুরুষ, ট্যুর গাইড থেকে শুরু করে ইতিহাসে আগ্রহী মানুষ আপনাকে জানাবে কীভাবে জাহাঙ্গীর এবং নুরজাহান পরস্পরের প্রেমে পড়েন। কীভাবে নুরজাহান একটি মানুষ খেকো বাঘকে মেরে রক্ষা করেছিলেন একটি গ্রামের মানুষকে।

যদিও নুরজাহানের প্রেম, তাঁর সাহসিকতার অনেক কাহিনি ছড়িয়ে আছে। মুঘল প্রাসাদের অন্দরমহলে তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতা, প্রতিপত্তি এবং আকাঙ্খা  সম্পর্কে বিস্তারিত খুব কমই জানা যায়।

নুরজাহান ছিলেন একজন কবি, দক্ষ শিকারি এবং খুবই সৃজনশীল এক স্থপতি। আগ্রায় তাঁর তৈরি  নকশাতেই নির্মাণ করা হয়েছিল তাঁর বাবা-মার সমাধিসৌধ। পরে এই স্থাপত্য রীতিই নাকি তাজমহলের স্থাপত্য নকশার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

মুঘলদের পুরুষ শাসিত জগতে নুরজাহান ছিলেন এক অসাধারণ নারী। কোনও রাজকীয় পরিবার থেকে তিনি আসেননি। তারপরও সম্রাটের হারেমে তাঁর উত্থান ঘটে এক দূরদর্শী রাজনীতিক হিসেবে। তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরের সবচেয়ে প্রিয়তম স্ত্রীতে পরিণত হন। বিশাল মুঘল সাম্রাজ্য আসলে তিনি ও সম্রাট জাহাঙ্গীর মিলে একসঙ্গেই শাসন করতেন।

কিন্তু যে যুগে অন্দর মহলের বাইরে নারীর কোনও স্থান ছিল না, সেই যুগে তিনি কিভাবে এত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন?

নুরজাহানের জন্ম হয়েছিল ১৫৭৭ সালে কান্দাহারের কাছে (আজকের আফগানিস্তানে)। তাঁর পরিবার ছিল ইরানের এক অভিজাত বংশের। কিন্ত সাফাভিদ রাজবংশের অসহিষ্ণুতার কারণে তাঁদেরকে সেখান থেকে পালিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যে এসে আশ্রয় নিতে হয়।

পিতা-মাতার জন্ম স্থানের ঐতিহ্য আর মুঘল রীতি-নীতি- এই দুটির আবহে বেড়ে ওঠেন নুরজাহান। তাঁর প্রথম বিয়ে হয় এক মুঘল রাজকর্মচারীর সঙ্গে। তাঁর স্বামী ছিলেন সেনা কর্মকর্তা। স্বামীর সঙ্গে তিনি পূর্ব ভারতের বাংলায় চলে আসেন। সেখানেই তাঁর একমাত্র ছেলের জন্ম হয়।

তবে সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রে জড়িত অভিযোগে নুরজাহানের স্বামীর চাকরি যায়। এক লড়াইয়ে নিহত হন নুরজাহানের স্বামী। বিধবা নুরজাহানকে পাঠানো হয় মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের হারেমে। সেখানে নুরজাহান অন্য মুঘল নারীদের আস্থা এবং বিশ্বাসের পাত্র হয়ে ওঠেন। ১৬১১ সালে সম্রাজ জাহাঙ্গীর তাঁকে বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন জাহাঙ্গীরের ২০তম পত্নী।

সেই সময়ের মুঘল রাজদরবারের রেকর্ডে খুব কম নারীর কথাই উল্লেখ আছে। তবে সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্মৃতিকথায় ১৬১৪ সালের পর থেকে তাঁর সঙ্গে নুরজাহানের বিশেষ সম্পর্কের উল্লেখ রয়েছে বার বার। তিনি নুরজাহানের এক অনুরাগময় চিত্রই একেঁছেন তাতে। নুরজাহান সেখানে বর্ণিত হয়েছেন একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী, চমৎকার সেবাদাত্রী, বিজ্ঞ পরামর্শদাতা, দক্ষ শিকারি, বিচক্ষণ কূটনীতিক এবং শিল্পবোদ্ধা হিসেবে।

অনেক ইতিহাসবিদের মতে জাহাঙ্গীর ছিলেন এক মদমত্ত সম্রাট, যার সাম্রাজ্য পরিচালনায় কোনও  মনোযোগ ছিল না। সে কারণেই নাকি তিনি এর ভার ছেড়ে দিয়েছিলেন স্ত্রীর হাতে। কিন্তু এটি পুরোপুরি সত্য নয়।

এটি সত্য যে জাহাঙ্গীর পানাসক্ত ছিলেন, তিনি আফিমও গ্রহণ করতেন। কিন্তু তিনি একইসঙ্গে তাঁর স্ত্রী নুরজাহানকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। কিন্তু এ  কারণেই নুরজাহান মুঘল সাম্রাজ্য শাসনের সুযোগ পেয়েছিলেন ব্যাপারটা তা নয়। কার্যত নুরজাহান এবং জাহাঙ্গীর ছিলেন পরস্পরের পরিপূরক। স্ত্রী যে সাম্রাজ্য শাসনে তাঁর পাশে আসন নিয়েছিলেন, সেটি নিয়ে জাহাঙ্গীরের কোনও অস্বস্তি ছিল না।

তাঁদের বিয়ের পরপরই নুরজাহান প্রথম যে রাজকীয় ফরমান জারি করেছিলেন তা ছিল এক রাজকর্মচারীর জমির অধিকার রক্ষায়। সেখানে তিনি স্বাক্ষর করেন নুরজাহান পাদশাহ বেগম নামে, যার অর্থ নুরজাহান, সাম্রাজ্ঞী। তিনি যে সার্বভৌম এবং তাঁর ক্ষমতা যে বাড়ছে, এটি ছিল তারই ইঙ্গিত।

১৬১৭ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর এবং তাঁর নাম লেখা মূদ্রা স্বর্ণ এবং রৌপ্য ছাড়া হয়। সেসময়ের মুঘল রাজদরবারের লেখক, বিদেশি কূটনীতিক, বণিক এবং পর্যটকরা উপলব্ধি করতে শুরু করেন যে মুঘল সাম্রাজ্য পরিচালনায় তার একটা বিরাট প্রভাব রয়েছে।

একজন রাজকর্মচারী একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছিলেন তাঁর লেখায়। নুরজাহান একদিন রাজপ্রাসাদের বারান্দায় দেখা দিয়েছিলেন। এটি এর আগে পর্যন্ত কেবল পুরুষদের জন্যই সংরক্ষিত ছিল।

তবে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে নুরজাহানের এটিই একমাত্র বিদ্রোহ ছিল না। শিকারে বের হওয়া থেকে শুরু করে নিজের নামে রাজকীয় মূদ্রা এবং রাজকীয় ফরমান জারি, বড় বড় রাজকীয় ভবনের নকশা তৈরি, দরিদ্র নারীদের কল্যাণে ব্যবস্থা গ্রহণ, এরকম নানা কাজে নুর জাহান তার স্বাক্ষর রেখেছেন। যা ছিল সেকালের নারীদের মধ্যে ব্যতিক্রম।

তার স্বামীকে যখন জিম্মি করা হয়, তখন নুরজাহান তাঁকে রক্ষায় সেনাবাহিনীর অধিনায়কের দায়িত্বও পালন করেছেন, যা তাকে ইতিহাসের পাতায় আর জনমানস চির দিনের জন্য স্থায়ী জায়গা করে দিয়েছে।

রুবি লাল ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক। তাঁর সর্ব সাম্প্রতিক প্রকাশিত গ্রন্থ ‘দ্য এস্টোনিশিং রেন অব নুর জাহান’ বইটি প্রকাশ করেছে পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের  ডাব্লিউডাব্লিউ নর্টন।

Share!

About newsfair

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top