বিশ্বকাপে এমন অনেক দল অংশ নেয়, যাদের হয়তো রাজনৈতিক অর্থে ‘দেশ’ বলা যায় না। বাছাই পর্বে এমন দলের সংখ্যা প্রচুর, তাদের কেউ কেউ যে মূল পর্বে উতরে আসে না, ব্যাপারটা তা-ও নয়। ধরা যাক ওয়েলসের কথাই। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড মিলে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য; এই চার দেশের ক্রীড়াবিদরা অলিম্পিকে একই সঙ্গে গ্রেট ব্রিটেন হিসেবে অংশ নিলেও ফুটবলে সবাই আলাদা। জিব্রাল্টার, গুয়াম এসব দল বাছাই পর্বে খেলে বটে, তবে তারাও ঠিক স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি বিশ্বমানচিত্রে। তবু তো তাদের একটা ফুটবল দল আছে, আছে পতাকা। কিন্তু রাজনৈতিক ডামাডোলের দখলদারিত্বের পৃথিবীতে এখনো এমন জাতিসত্তা রয়ে গেছে, যাদের দেশ হারিয়ে গেছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মানচিত্রের ভেতর। তিব্বত, আবখাজিয়াসহ এমন সব দেশ মিলেই গড়ে তুলেছে বিকল্প সংগঠন কনফেডারেশন অব ইনডিপেনডেন্ট ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনস কনিফা। তাদের আয়োজনেই লন্ডনে শুরু হয়েছে ‘নেই’ দেশের বিশ্বকাপ।
এখানে খেলার চেয়ে রাজনীতিটাই মুখ্য। এই বিশ্বকাপে খেলতে এসে পতাকার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে যান ভিনদেশে শরণার্থী হয়ে বেঁচে থাকা অনেকে। তিব্বত, দারফুর, আবখাজিয়া, কুর্দি, তামিল অনেক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের ফুটবল দলই অংশ নেয় এই বিশ্বকাপে। ওড়ানো হয় সেই সব নেই দেশের পতাকা। ৮০০ তিব্বতি শরণার্থী আছেন ইংল্যান্ডে, তাদের ভেতর লন্ডনেই থাকেন ৪০০ জন। ১৫০ জনের মতো তিব্বতি এসেছিলেন মাঠে, তাদেরই একজন ফুংসুক দালু জানালেন, ‘এই একটা উপায়েই আমরা আমাদের অস্তিত্বের কথা জানাতে পারি। সাধারণত লোকে তিব্বতকে আলাদা দেশ হিসেবে দেখে না, এখানেই আমরা সেটা বলতে পারি। আমরা দেশের স্বাধীনতার কথা বলতে এখানে আসি, ফুটবলের জন্য নয়।’ ভারত ও চীনের মাঝে আটকে তিব্বত যেমন নিজেদের মুক্তির পথ খুঁজছে, তেমনি রাশিয়া ও জর্জিয়ার বিরোধে আটকে গেছে আবখাজিয়ার বাসিন্দাদের স্বাধীন দেশ ও পতাকার স্বপ্ন। কৃষ্ণ সাগরের পারে আবখাজিয়াকে রাশিয়া দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও জাতিসংঘ ও বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের কাছেই আবখাজিয়া জর্জিয়ার একটি অংশ বলেই বিবেচিত। দীর্ঘদিন ধরে ইংল্যান্ডে বসবাস করে এলেও শিকড়ের কথা ভুলে যাননি আবখাজ অভিবাসী চকতুয়া আতাখান, ‘আমার বয়স ৪৩, আমি একদমই ফুটবল বুঝি না। কখনো মাঠেও যাই না খেলা দেখতে। তবে এই আয়োজনটা আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে। আমরা স্বাভাবিক একটা দেশ। শুধু স্বীকৃতি নেই।’
ধর্মশালায় তিব্বতিদের শরণার্থী আশ্রয়স্থলে, কাদাপানির মাঠে খেলেন তিব্বতি ফুটবলাররা। খেলার মাঝে গরু এসে দেয় বাগড়া। তাদের নিয়েই কোচ পেনপা শেরিং এসেছেন দেশহীনদের বিশ্বকাপে অংশ নিতে। উদ্বোধনী ম্যাচটি আবখাজিয়ার কাছে তিব্বতিরা হেরেছে ৩-০ গোলে। তাতে কি! তিব্বতের পতাকা উড়িয়ে, ঢোলের বাদ্য বাজিয়ে ঠিকই নিজেদের জাতিসত্তার কথা জানান দেওয়া গেছে। এই বিশ্বকাপে তো শিরোপার লড়াইয়ের চেয়ে অস্তিত্বের লড়াইটাই বড়! এএফপি