কোনো কিছুই এখন মানুষের চোখ এড়ায় না। কিন্তু চোখ তো প্রমাণ রাখতে পারে না, যা পারে ক্যামেরা। সেই ক্যামেরায়বন্দি হলো, রামোসের কুৎসিত হাসি। মোহাম্মদ সালাহ যখন ঘাড়ের যন্ত্রণায় কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়ছিলেন, তখন কুৎসিতভাবে হাসছিলেন তিনি। সেই হাসি বন্দি হয়েছে ক্যামেরায়। আর এখন দেখেছে সারাবিশ্ব।
সালাহকে মাঠে ফেলে দেয়ার পর হাত সরিয়ে নেন সার্জিও রামোস। রেফারিকে বলেন, তিনি নির্দোষ। তা-ই মেনে নেন রেফারি।
ফিজিও এসে সালাহকে দেখে মাঠের বাইরে নিয়ে যান, তখন ক্যামেরা তাক করা ছিল রামোসের দিকে। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিক্রিয়া নেয়ার চেষ্টা। তা পেয়েও যান ক্যামেরাম্যান। সালাহকে মাঠ ছাড়তে দেখে কুৎসিতভাবে হাসতে থাকেন রামোস।
এই ছবি প্রকাশ হওয়ার পর ফুটবলবিশ্ব ধিক্কার দিচ্ছে এই রিয়াল মাদ্রিদ খেলোয়াড়কে। তাকে ভিলেন বলে সম্বোধন করা হচ্ছে।
গ্যালারি শুদ্ধ মানুষ যখন সালাহর জন্য কাঁদছেন, তখন স্বস্তির হাসি হাসছিলেন রামোস। যেন পথের কাটা দুর করে তৃপ্ত তিনি।
টুইটারে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। একজন সমালোচনা করে বলেছেন, ‘সালাহ যখন মাঠ ছাড়ছিলেন, শয়তানের মতো হাসছিলেন রামোস।’
আরেকজন টুইট করেছেন, ‘রামোস দেখতে তখন জঘন্য লাগছিল।’
ক্ষুদ্ধ আরেকজন বলেন, ‘আমি ভাবতেই পারছি না রামোস কীভাবে এমন একটা কাজ করলেন?’
রামোসকে ধিক্কার জানিয়ে একজন লিখেছেন, ‘বাজে কাজ করেছেন রামোস। সে ভয়ঙ্কর একজন খেলোয়াড়।’
ফুটবল না, কুস্তি করতে নেমেছিল রোনালদোরা
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শুরুটা ভালোই ছিল। রোনালদোর রিয়াল মাদ্রিদ আর সালাহর লিভারপুল লড়ে যাচ্ছিল। বল নিজেদের দখলে বেশি রাখছিলেন সালাহরা। কয়েকবারই রিয়ালের জালে আক্রমণ চালিয়েছে তারা। তাতেই হয়ত আতঙ্ক জেকে ধরেছিল রোনালদোদের। এরপর তাদের লক্ষ্য হয়ে উঠেছিলেন লিভারপুলের প্রাণভোমরা সালাহ। বার বার তাকে আক্রমণ করা হচ্ছিল। একটা পর্যায়ে তারা এ কাজে সফলও হয়। সার্জিও রামোস সালাহর হাত এমনভাবে আটকান যে, মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সালাহ। হাত বাঁকিয়ে চাপা পড়ে তার শরীরেই। ব্যাথায় ছটফট করেন সালাহ। তখন রামোস নির্দোষ ভাব করে সরে পড়েন। রেফারিও টু শব্দ করেন না। এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত লিভারপুল বস ক্লপ। ম্যাচ শেষে বলেন, ‘মনে হচ্ছিল কুস্তি হচ্ছে।’
প্রথমার্ধেই কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়েন সালাহ। চোট পেয়েও মাঠে নেমেছিলেন সালাহ। কিন্তু টিকতে পারেননি। ব্যাথায় ককিয়ে উঠে মাঠে লুটিয়ে পড়েন। পুরো গ্যালারি তখন স্তব্ধ!
সবাই দৌড়ে এসে সালাহকে ঘিরে ধরলেন। সালাহকে উঠে দাড় করালেন, কথা বললেন। এরপর অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকেন সালাহ। লিভারপুলকে স্বপ্নের শিরোপাটা উপহার দেয়া হলো না।
ওইদিকে গ্যালারিতে সালাহ-ভক্তরা কেউ মুখে হাত দিয়ে বসে আছেন। কেউ চোখ মুছছেন। আর সালাহ…। সালাহ কাঁদছেন…।
এই ঘটনার পর কার্যত ম্যাচ হাতছাড়া হয়ে যায় লিভারপুলের। ৩-১ ম্যাচ জিতে নেয় রিয়াল।
ম্যাচ শেষে লিভারপুল বস তাদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘আমি জানি, এ ধরণের একটি ম্যাচে হেরে যাওয়ার পর কিছু বললে, সবাই ব্যর্থতার বুলি আওড়াচ্ছি বলবেন। তবুও বলছি, ম্যাচটি কিছুটা কুস্তির মতো হয়ে গিয়েছিল। যার ফলে সালাহ ঘাড়ে মারাত্মক চোট পেয়ে মাঠ ছেড়েছেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘যা হয়েছে তা কাম্য ছিল না। ছেলেরা এই ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেছে। তারা হতাশায় ডুবি গিয়েছিল, সেই সুযোগটাই রিয়াল কাজে লাগিয়েছে।’
মোনাজাত করে মাঠে ঢুকেছিলেন সালাহ
ফাইনাল শুরুর আগেই উত্তেজনার তুঙ্গে ছিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। কারণ বর্তমান ফুটবলবিশ্ব কাঁপানো মিসরের রাজপুত্র মোহাম্মদ সালাহর প্রতিপক্ষ ছিল রিয়াল মাদ্রিদের প্রাণভোমরা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। যার এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ৩৮ গোলের রেকর্ড ভেঙেছিলেন সালাহ। এক মৌসুমে সালাহর গোল ৪৪টি। তাই ফাইনাল ম্যাচটি নিয়ে আগ্রহ ছিল ফুটবলবিশ্বের। মাঠে নামার আগে চাপে ছিলেন রোনালদো, সেটা তার মুখ দেখে যে কেউ অনুমান করতে পারবে। অপরদিকে নির্ভার ছিলেন সালাহ। স্বভাবজাত হাসি মুখেই ছিলেন তিনি। ধর্মপ্রাণ সালাহ মুসলিম-অমুসলিম সবারই ছিলেন চোখেরমণি। মাঠে নেমে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার পর রেফারির বাশি বাজার আগ মুহূর্তে মহান আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেন তিনি।
হাইভোল্টেজ ম্যাচটিতে সবার আগ্রহ ছিলে রোনালদো আর সালাহর দ্বৈরথ দেখার। তাই গ্যালারিতে উপচে পড়া দর্শক। ম্যাচ শুরুর আগে রোনালদো অনেক চাপে ছিলেন, প্রতিনিয়ত তার সাথে তুলনা করা হচ্ছিল সালাহর। ম্যাচের দিন কয়েক আগে তিনি বলেই দিয়েছিলেন, সালাহর সাথে তার তুলনা কী করে হয়? ‘সালাহ বাম পায়ে খেলেন আর তিনি ডান পায়ে। তিনি লম্বা আর সালাহ খাটো।’
লিভারপুল বস ক্লপও বার বার রোনালদোর সাথে সালাহর তুলনা করতে নিষেধ করেছিলেন। কারণ সালাহর মাত্র শুরু আর রোনালদো অনেক অভিজ্ঞ।
ম্যাচ শুরুর আগে তাই উত্তাপ আঁচ করা ছিল সহজ। সেই ম্যাচে মাঠে নামার আগে সাবলীল ছিলেন সালাহ। হাসি লেগেই ছিল মুখে। ম্যাচ শুরুর আগে মহান আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে মোনাজাত করেন সালাহ। তারপর খেলা শুরু করেন তিনি। রিয়ালের জালে একের পর এক আক্রমণ চালায় সালাহরা। কিছু সময়ের জন্য বল বাগে পেলেও তা ছিনিয়ে নেয় লিভারপুল। এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল।
কিন্তু ম্যাচটি সৌন্দর্য হারায় যখন রিয়ালের রামোস সালাহকে আটকাতে গিয়ে হাত ধরে হেঁচকা টান দেন। ভারসাম্য রাখতে না পেরে পড়ে যান সালাহ। মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ার সময় বাম হাতটি পড়ে যায় তার গায়ের নিচে। ফলে ব্যাথায় ককিয়ে উঠেন তিনি। হয়ত তখনই বুঝতে পারেন, কী হয়েছে তার। এই কাণ্ডের পর রামোস নিজেকে নির্দোষ বলে সরে পড়েন। রেফারিও তাকে ছেড়ে দেন।
গ্যালারি শুদ্ধ সালাহ ভক্তরা তখন মুখে হাত দিয়ে বসে পড়েন। এরপরও মাঠের বাইরে নেয়া হলেও ফিরে আসেন সালাহ। আশায় বুক বাধে ভক্তরা। কিন্তু এক মিনিটও টিকতে পারেননি তিনি। ব্যাথায় লুটিয়ে পড়েন। এরপর কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়েন সালাহ। শেষ হয় তার শিরোপা জয়ের লড়াই, শেষ হয় লিভারপুলেরও। বিউটিফুল গেম তার সৌন্দর্য হারায়…।
টানা তৃতীয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় রিয়াল মাদ্রিদের
গ্যারেথ বেলের দুই গোলে – যার মধ্যে একটি চোখ ধাঁধানো ওভারহেড কিক ছিল -রিয়াল মাদ্রিদ লিভারপুলকে হারিয়ে টানা তৃতীয়বারের মত চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জিতেছে।
ম্যাচের প্রথমার্ধেই ঘাড়ে চোট পাওয়ায় মাঠ ছাড়েন লিভারপুলের মিসরীয় ফরোয়ার্ড মোহাম্মদ সালাহ।
লিভারপুল গোলরক্ষক লরিস কারিয়ুসের হাস্যকর এক ভুলের সুযোগ কাজে লাগিয়ে করিম বেনজেমা গোল করলে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই এগিয়ে যায় রিয়াল। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে গোল করে লিভারপুলকে সমতায় ফেরান সাদিও মানে।
তবে বদলি হিসেবে মাঠে নামার তিন মিনিটের মধ্যেই রিয়ালকে আবার এগিয়ে নেন গ্যারেথ বেল। তার ওই গোলকে মনে করা হচ্ছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলগুলোর একটি।
লিভারপুলের ষষ্ঠ ইয়োরোপিয়ান কাপের স্বপ্নভঙ্গ হয় গোলরক্ষক কারিয়ুসের আরেকটি ভুলে। গ্যারেথ বেলের দূরপাল্লার শট বুঝতে ভুল করে নিজের জালেই বল জড়ান এই জার্মান গোলরক্ষক।
শেষপর্যন্ত ৩-১ গোলে ম্যাচ জিতে জয়ে ১৩তম ইউরোপীয়ান কাপ শিরোপা নিশ্চিত করে রেয়াল মাদ্রিদ।
৪২ বছরে প্রথমবার – পরিসংখ্যান
বায়ার্ন মিউনিখের (১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬) পর প্রথম ক্লাব হিসেবে টানা তিনবার ইয়োরোপিয়ান কাপ/চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতলো রেয়াল মাদ্রিদ।
তিনটি ইয়োরোপিয়ান কাপ/চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা তৃতীয় ম্যানেজার জিনেদিন জিদান (বব পেইসলি ও কার্লো অ্যানচেলত্তির পর)। তবে টানা তিনবার এই শিরোপা জেতা একমাত্র ম্যানেজার তিনি।
ম্যানেজার হিসেবে খেলা সাতটি মেজর ফাইনালের ছয়টিতেই হেরেছেন ইয়ুর্গেন ক্লপ।
বদলি হিসেবে নেমে ইয়োরোপিয়ান কাপ/চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে দুই গোল করা একমাত্র খেলোয়াড় গ্যারেথ বেল।
বদলি হিসেবে নামার দুই মিনিট দুই সেকেন্ড পর গ্যারেথ বেল গোল করেন যা ১৯৯৭ এ য়ুভেন্টাসের বিপক্ষে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের লার্স রিকেনের পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে কোনো বদলি খেলোয়াড়ের দ্রুততম গোল।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ/ইউরোপীয় কাপ ফাইনালে দুই গোল করা দ্বিতীয় বৃটিশ খেলোয়াড় গ্যারেথ বেল। ১৯৬৮ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে ববি চার্লটন দুই গোল করেছিলেন।
লিভারপুল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ইতিহাসের প্রথম দল যাদের তিনজন খেলোয়াড় এক মৌসুমে ১০টি বা তার বেশি গোল করেছে (সালাহ ১০, ফিরমিনো ১০, মানে ১০)